সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রে আঘাত হানতে সক্ষম এমন পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র উন্মোচন করল উ. কোরিয়া


সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রে আঘাত হানতে সক্ষম এমন পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র উন্মোচন করল উ. কোরিয়া

বিশ্বমঞ্চে নিজের সামরিক শক্তি জানান দিতে আবারও দৃষ্টি কেড়েছে উত্তর কোরিয়া। পিয়ংইয়ং শনিবার জানিয়েছে, দেশটি নতুন একটি আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (ICBM) উন্মোচন করেছে, যা তাদের ভাষায় এখন পর্যন্ত “সবচেয়ে শক্তিশালী পারমাণবিক কৌশলগত অস্ত্র”। হোয়াসং-২০ নামের এই নতুন ক্ষেপণাস্ত্র প্রদর্শিত হয়েছে এক বিশাল সামরিক কুচকাওয়াজে, যেখানে উপস্থিত ছিলেন নেতা কিম জং-উন নিজেও।

সামরিক শক্তিকেই সার্বভৌমত্ব রক্ষার একমাত্র উপায় হিসেবে তুলে ধরে কিম বলেন, “আমাদের সেনাবাহিনীকে এমন একটি অজেয় শক্তিতে পরিণত করতে হবে, যারা রাজনৈতিক, আদর্শিক, সামরিক ও কারিগরি শ্রেষ্ঠত্বের মাধ্যমে শত্রুকে পরাস্ত করবে।”

তিনি আরও বলেন, উত্তর কোরিয়াকে হতে হবে এমন এক “উচ্চ নৈতিকতা ও শৃঙ্খলাবোধসম্পন্ন অভিজাত বাহিনী, যারা ধারাবাহিকভাবে বিজয় অর্জন করতে সক্ষম”।

হোয়াসং-২০ ক্ষেপণাস্ত্রটি কঠিন জ্বালানিভিত্তিক হওয়ায় এটি তুলনামূলকভাবে বেশি মোবাইল, সহজে স্যাটেলাইটে শনাক্ত করা যায় না এবং স্বল্প নোটিশে উৎক্ষেপণ সম্ভব। সামরিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এ ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র যুক্তরাষ্ট্রের যে কোনো অংশে পৌঁছাতে সক্ষম।

কিম তার ভাষণে যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি হুমকি না দিলেও বলেন, উত্তর কোরিয়া “অবিচার ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে” সংগ্রাম চালিয়ে যাবে। এখানে ইঙ্গিত ছিল ওয়াশিংটনের দিকেই। তবে আগের মতই তিনি জানান, যদি যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ দাবি পরিত্যাগ করে, তবে সংলাপে বসার পথ উন্মুক্ত রয়েছে।

**রাশিয়ার সহায়তা?**

টেলিভিশনে প্রচারিত কুচকাওয়াজের ফুটেজে দেখা যায়, বিশাল এক বৃত্তাকার নাকযুক্ত ক্ষেপণাস্ত্র একটি ১১-অ্যাক্সেলের ট্রেলারে চড়ে কিম ইল-সাং স্কোয়ারের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে, আর দর্শকরা নানা স্লোগানে মুখরিত।

“এটি সম্পূর্ণ নতুন ধরনের ICBM, যা একাধিক টার্গেটকে একসঙ্গে আঘাত হানতে পারে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূলে,” বলেন কোরিয়া ডিফেন্স নেটওয়ার্কের পরিচালক লি ইল-উ।

তিনি বলেন, হোয়াসং-২০ দেখতে ভারী এবং এর বড় ও গোলাকার নাক নির্দেশ করে যে এতে “মাল্টিপল ইন্ডিপেনডেন্টলি টার্গেটেবল রি-এন্ট্রি ভেহিকলস” (MIRVs) থাকতে পারে, যা একাধিক টার্গেটে পৃথকভাবে আঘাত হানতে সক্ষম। এই প্রযুক্তি যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে।

লি আরও বলেন, “আমার সন্দেহ হচ্ছে, রাশিয়া এই ক্ষেপণাস্ত্র তৈরিতে উত্তর কোরিয়াকে সহায়তা করেছে।” তিনি হোয়াসং-২০ এর সঙ্গে রাশিয়ার টোপোল-এম ক্ষেপণাস্ত্রের মিল খুঁজে পান, যার পাল্লা ১১,০০০ কিমি।

তবে কোরিয়া ইনস্টিটিউট ফর ন্যাশনাল ইউনিফিকেশনের গবেষক চো হান-বুম সতর্ক করে বলেন, “এই অস্ত্র নিয়ে অতিরিক্ত কল্পনা না করাই ভালো।” তিনি মনে করিয়ে দেন, হোয়াসং-১৫ উন্মোচনের সময় ২০১৭ সালে উত্তর কোরিয়া পারমাণবিক শক্তির ঘোষণা দিলেও এখন পর্যন্ত কোনো ICBM-এর ফ্লাইট টেস্ট সম্পন্ন করেনি।

তিনি বলেন, “বিশেষত পুনঃপ্রবেশের সময় তাপমাত্রা সহ্য করার সক্ষমতা যাচাই করতে ফ্লাইট টেস্ট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”

উত্তর কোরিয়া বর্তমানে তাদের পাঁচ বছরব্যাপী প্রতিরক্ষা পরিকল্পনার শেষ বছরে রয়েছে, যেখানে ক্ষেপণাস্ত্র ও অন্যান্য অস্ত্র উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত করা হয়েছে।

**রাশিয়া-উত্তর কোরিয়া মিত্রতা জোরদার**

একই ভাষণে কিম ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার পাশে উত্তর কোরিয়ার সৈন্যদের সাহসিকতার প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, “বিদেশি যুদ্ধক্ষেত্রে আমাদের বিপ্লবী সেনাবাহিনীর বীরত্ব এবং বিজয় আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার ও প্রকৃত শান্তির জন্য আমাদের সেনাবাহিনীর আদর্শিক ও আত্মিক পরিপূর্ণতা প্রমাণ করেছে।”

পর্যবেক্ষক স্ট্যান্ড থেকে কিম কুচকাওয়াজ উপভোগ করেন চীনের প্রধানমন্ত্রী লি ছিয়াং, ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান তো লাম এবং রাশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভের সঙ্গে। কুচকাওয়াজে যুদ্ধফেরত উত্তর কোরিয়ান সেনারা “নির্বিচার আনুগত্য”-এর স্লোগান দিতে দিতে রাশিয়ার ও উত্তর কোরিয়ার পতাকা হাতে স্কোয়ারের মধ্য দিয়ে মিছিল করে।

“রক্তের বিনিময়ে গড়া মৈত্রী রাশিয়ার সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার শক্ত জোটের প্রমাণ দিচ্ছে,” বলেন কোরিয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউট ফর ন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজির গবেষক দু জিন-হো।

তিনি বলেন, “মূলত কিম ওয়াশিংটনকে বার্তা দিচ্ছেন যে, উত্তর কোরিয়া এখন এমন একটি পারমাণবিক শক্তি, যার অবস্থান আর উল্টানো সম্ভব নয়।”

বিশ্লেষকদের মতে, কিমের বক্তব্যে সরাসরি আগ্রাসনের সুর ছিল না, বরং এটি ছিল কৌশলগতভাবে পরিমিত এবং আত্মবিশ্বাসী। “কিমের ভাষা ছিল সুষম, যা ইঙ্গিত করে পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার সম্প্রসারণ, রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠকরণ এবং চীনের সঙ্গে উষ্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠায় উত্তর কোরিয়ার আত্মবিশ্বাস বেড়েছে,” বলেন দু জিন-হো।

চো হান-বুম যোগ করেন, চীন, রাশিয়া এবং অন্যান্য এশীয় দেশের শীর্ষ নেতাদের উপস্থিতিতে কিম আগের মতো আক্রমণাত্মক বক্তব্য থেকে বিরত থেকেছেন।

**হাইপারসনিক অস্ত্রের ঝলক**

কুচকাওয়াজে আরও প্রদর্শিত হয় হোয়াসং-১১এমএ, একটি স্বল্প পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র, যা হাইপারসনিক ওয়ারহেডে সজ্জিত। এটি দক্ষিণ কোরিয়ার জন্য একটি বড় হুমকি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

এই ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা ১,০০০ কিমি হওয়ায় জাপানের কিউশু অঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে, যেখানে মার্কিন নৌবাহিনীর উপস্থিতি রয়েছে।

“কিমের বক্তব্যের সারাংশ তিনটি: এক, আমরা পারমাণবিক ও প্রচলিত উভয় অস্ত্র উন্নয়ন বাড়াব; দুই, যুক্তরাষ্ট্রের হুমকি ক্রমেই বাড়ছে; এবং তিন, আমরা রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ঐক্য গড়ে তুলব,” বলেন লি ইল-উ।

এর আগে শুক্রবার কিম জং-উন পিয়ংইয়ংয়ে মেদভেদেভের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং দুই দেশের “কৌশলগত অংশীদারিত্ব” আরও জোরদারের আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম জানায়, “তিনি বিশ্বাস প্রকাশ করেছেন যে এই সফর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে আরও গতিশীল, বিস্তৃত এবং কৌশলগত মিত্রতায় উন্নীত করতে একটি তাৎপর্যপূর্ণ উপলক্ষ হবে।”

ঢাকাওয়াচ২৪ডটকমে লিখতে পারেন আপনিও ফিচার, তথ্যপ্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, ভ্রমণ ও কৃষি বিষয়ে। আপনার তোলা ছবিও পাঠাতে পারেন [email protected] ঠিকানায়।
×