দেশে ৩.৮ কোটি নারী বাল্যবিবাহের শিকার, মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন জরুরি


দেশে ৩.৮ কোটি নারী বাল্যবিবাহের শিকার, মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন জরুরি

বাংলাদেশে মেয়েদের অধিকার সুরক্ষার পথে বাল্যবিবাহ অন্যতম প্রধান বাধা। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ হার এবং বিশ্বব্যাপী সপ্তম অবস্থানে থাকার কারণে এটি একটি গভীর উদ্বেগের বিষয়। দেশের বিবাহিত নারীদের মধ্যে প্রায় ৩ দশমিক ৮ কোটি নারী বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছেন। এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য শিক্ষা, ক্ষমতায়ন, সামাজিক সুরক্ষা এবং মানুষের মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন জরুরি।

সোমবার (২৫ আগস্ট) রংপুরে আরডিআরএস’র বেগম রোকেয়া মিলনায়তনে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে বহু-পক্ষীয় অংশগ্রহণকারীদের জন্য সহায়ক নির্দেশিকা ‘অ্যাডভোকেসি টুলকিট’ এর মোড়ক উন্মোচন করা হয়। অনুষ্ঠানে সরকারি ও বেসরকারি দপ্তরের কর্মকর্তা, শিক্ষক, সাংবাদিক, আইনজীবী, ধর্মীয় নেতা, কাজী, মানবাধিকারকর্মী ও শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ উপস্থিত ছিলেন।

মালালা ফান্ডের সহযোগিতায় পিপলস ওরিয়েন্টেড প্রোগ্রাম ইমপ্লিমেন্টেশন (পপি) ও বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্ক ফাউন্ডেশনের যৌথ উদ্যোগে আয়োজন করা হয় জয়েন্ট অ্যাকশন গ্রান্ট প্রজেক্টের অংশ হিসেবে। অনুষ্ঠানে পপি’র কনসোর্টিয়াম সমন্বয়কারী কাজী আব্দুল্লাহ রিজভান বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের বর্তমান পরিস্থিতি এবং অ্যাডভোকেসি টুলকিট নিয়ে আলোচনা করেন।

তিনি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও ইউনিসেফ পরিচালিত পাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে ২০১৯-এর তথ্য উদ্ধৃত করে বলেন, আইন প্রণয়ন এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির প্রচেষ্টা থাকা সত্ত্বেও ২০-২৪ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে ৫১.৪ শতাংশ ১৮ বছরের আগে বিয়ে করেছেন। ২০১৭ সালে সরকার বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন প্রণয়ন করেছে, যেখানে মেয়েদের ন্যূনতম বিয়ের বয়স ১৮ বছর। তবে ধারা ১৯-এ ‘বিশেষ পরিস্থিতিতে’ বিয়ের অনুমতির সুযোগ থাকায় আইন কার্যকরভাবে প্রয়োগ হচ্ছে না।

আঞ্চলিকভাবে বাল্যবিবাহের হার সবচেয়ে বেশি রাজশাহী ও খুলনা বিভাগে, এরপর রংপুরের অবস্থান। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, রাজশাহী বিভাগে ৬৬.৭%, খুলনা ৬১.৮%, রংপুর ৫৭.৯%, বরিশাল ৫৫.৬%, ময়মনসিংহ ৫২.২%, ঢাকা ৪৮.৬%, চট্টগ্রাম ৪৪.১% এবং সিলেটে ৩১%।

অনুষ্ঠানে রংপুরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পরিমল কুমার সরকার, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১-এর সাবেক এপিপি অ্যাডভোকেট আফরোজা শারমিন কনা, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. তুহিন ওয়াদুদ, পপি’র ইমপ্লিমেন্টেশন অফিসার মাহমুদ মীম এবং বিডিওএসএন প্রোগ্রাম ফোকাল তানভীরুল ইসলাম বক্তব্য দেন।

আলোচকরা বলেন, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে শুধু আইন প্রণয়ন বা প্রয়োগ যথেষ্ট নয়। আইন কখনও কখনও অপব্যবহৃত হয়। এজন্য শিক্ষার প্রসার, মেয়েদের ক্ষমতায়ন, সামাজিক সুরক্ষা এবং মানুষের মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন অপরিহার্য। জাতীয় কর্মপরিকল্পনা (২০১৮–২০২৩) অনুযায়ী, কমিউনিটি-ভিত্তিক বহুমুখী উদ্যোগ বাল্যবিবাহ কমাতে সহায়ক হবে এবং এসডিজি লক্ষ্য ৫.৩ অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

আলোচনায় বিশ্বের অন্যান্য দেশের বাল্যবিবাহের পরিস্থিতিও তুলে ধরা হয়। প্রতি পাঁচ জন মেয়ের মধ্যে একজন ১৮ বছরের আগে বিয়ে হয়। প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী প্রায় ১.২ কোটি মেয়ের বিয়ে ১৮ বছরের আগে হয়। বর্তমানে ৬৪ কোটি বিবাহিত নারী বাল্যবিবাহের শিকার, যার মধ্যে ২৫ কোটি ১৫ বছরের আগে বিবাহিত। প্রায় ৯০% কিশোরীর গর্ভধারণ বিয়ে বা অ-আনুষ্ঠানিক সম্পর্কের মাধ্যমে ঘটে। গর্ভধারণ ও প্রসবকালীন জটিলতা ১৫–১৯ বছর বয়সী মেয়েদের মৃত্যুর প্রধান কারণ। ২০৩০ সালের মধ্যে আরও ১৫ কোটির বেশি মেয়ের বিয়ে ১৮ বছরের আগে হতে পারে।

বাল্যবিবাহের মূল কারণ হিসেবে দারিদ্র্য, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, জেন্ডার বৈষম্য, সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা, যৌতুক নির্ভর বিয়ে, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ভুল ব্যাখ্যা, আইনের দুর্বল প্রয়োগ, পরিবার ও স্কুল থেকে ঝরে পড়া, স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সীমিত অংশগ্রহণ এবং আইনি ও সমাজসেবামূলক সমন্বয়ের অভাবকে চিহ্নিত করা হয়েছে।

অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন কুড়িগ্রাম সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক মুহা. হুমায়ুন কবীর, নারীনেত্রী মঞ্জুশ্রী সাহা, সাংবাদিক শফি খান, সংগঠক ও শিল্পী খ.ম সম্রাট আলী, সিড’র প্রধান নির্বাহী সারথী রানী সাহা, জেলা মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের ইমাম মাওলানা মো. জাহিদুল ইসলাম জাহিদ, কাজী হাফিজ মুহাম্মদ আব্দুল কাদির, সাংবাদিক মেরিনা লাভলী এবং মানবাধিকারকর্মী সামসে আরা বিলকিস।

ঢাকাওয়াচ২৪ডটকমে লিখতে পারেন আপনিও ফিচার, তথ্যপ্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, ভ্রমণ ও কৃষি বিষয়ে। আপনার তোলা ছবিও পাঠাতে পারেন [email protected] ঠিকানায়।
×