দক্ষিণ এশিয়ায় মুদ্রাস্ফীতিতে শীর্ষে বাংলাদেশ, পরিস্থিতি সবচেয়ে জটিল


দক্ষিণ এশিয়ায় মুদ্রাস্ফীতিতে শীর্ষে বাংলাদেশ, পরিস্থিতি সবচেয়ে জটিল

দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক চিত্রে দেশগুলোর পরিস্থিতি ভিন্ন ভিন্ন হলেও, বর্তমানে মুদ্রাস্ফীতির জের সবচেয়ে বেশি ভোগ করছে বাংলাদেশ। যদিও শ্রীলঙ্কা রাজনৈতিক অস্থিরতা পেরিয়ে বর্তমানে স্থিতিশীলতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এবং সেখানে মুদ্রাস্ফীতি মাত্র ১.৫ শতাংশে নেমে এসেছে, বাংলাদেশে দাম বৃদ্ধির হার এখনও উদ্বেগজনক মাত্রায় দাঁড়িয়ে আছে। সম্প্রতি রাজনৈতিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাওয়া নেপালে মুদ্রাস্ফীতির হার ৫.২ শতাংশ এবং অর্থনৈতিক সংকটে দিশাহারা পাকিস্তানে ৫.৬ শতাংশ। কিন্তু বাংলাদেশে এই হার ৮ শতাংশের উপরে থাকার কারণে ভোক্তারা ব্যাপক চাপের মুখে পড়েছেন। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশেই দাম বৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ, যেখানে ভারত ও শ্রীলঙ্কায় তা এক অঙ্কের নিচে রয়েছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ আগস্ট ২০২৫-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশের সামগ্রিক মুদ্রাস্ফীতি ৮.২৯ শতাংশে স্থিত। এর মধ্যে খাদ্যপণ্যের মুদ্রাস্ফীতি ৯.৩ শতাংশ এবং খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে ৭.১ শতাংশ। যদিও চাল, পেঁয়াজ, তেল ও ডিমের দাম আপাতত নিয়ন্ত্রণে আছে, শাকসবজি, মাংস ও দুধজাত পণ্যের দাম এখনো বেশ উচ্চ অবস্থায় রয়েছে, যা সামগ্রিক মুদ্রাস্ফীতির ওপর প্রভাব ফেলছে।

অর্থনীতিবিদদের মতে, সরকারি বাজার তদারকি ও খাদ্য মজুত বাড়ানোর উদ্যোগ কিছুটা সাফল্য এনে দিয়েছে। তবে কাঠামোগত ব্যয় বৃদ্ধি এবং টাকার অবমূল্যায়ন মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাড়িয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক নীতিগত সুদের হার অপরিবর্তিত রেখে মুদ্রাসরবরাহ সীমিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা কিছুটা দাম নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হতে পারে।

গত ৩০ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের গড় মুদ্রাস্ফীতি ছিল ৯.৭ শতাংশ, যা গত অর্থবছরের ১০ শতাংশ থেকে সামান্য কম হলেও ২০১৩ সালের পর সবচেয়ে বেশি। এদিকে মালদ্বীপ ও পাকিস্তানে এই হার ছিল ৪.৫ শতাংশ, নেপালে ৪.১ শতাংশ এবং ভারতের মুদ্রাস্ফীতি আরো কম। এডিবি পূর্বাভাস দিয়েছে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতি ৮ শতাংশে নেমে আসবে, তবে তাও দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ থাকবে।

অঞ্চলের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতি ধীরে ধীরে স্থিতিশীলতার পথে এগোচ্ছে, তবে খাদ্য ও জ্বালানি খাতে দামের বৃদ্ধি এখনও বড় উদ্বেগের কারণ। ভারত ও শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতা প্রমাণ করছে, কঠোর মুদ্রানীতি, কার্যকর বাজার নিয়ন্ত্রণ ও উৎপাদন উদ্দীপক নীতিমালা গ্রহণ করলে মুদ্রাস্ফীতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।

অর্থনীতিবিদরা জানাচ্ছেন, বাংলাদেশের দাম বৃদ্ধির মূল চালিকা শক্তি হলো খাদ্য ও জ্বালানির অভ্যন্তরীণ ব্যয় বৃদ্ধি। ভারতে কৃষি উৎপাদনের ধারাবাহিকতা ও বাজার ব্যবস্থাপনার দক্ষতা মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। শ্রীলঙ্কা কঠোর ব্যয় সংকোচন ও মুদ্রানীতি বাস্তবায়নের মাধ্যমে দ্রুত পুনরুদ্ধারে সফল হয়েছে।

বিশ্ববাজারে জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের দাম কিছুটা কমলেও বাংলাদেশ ব্যাংক গত দুই বছরে একাধিকবার নীতিমালা কঠোর করেও পর্যাপ্ত সাফল্য পায়নি। ২০২২ সালের মে থেকে ২০২৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ১১ দফায় নীতিমূল্য হার বাড়িয়ে ১০ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন মনে করেন, “যদি সময়মতো পদক্ষেপ নেওয়া যেতো, তাহলে ফলাফল ভিন্ন হতো। এখন অনেকটা দেরিতে নেওয়া পদক্ষেপ বা ‘টু লিটন, টু লেট’ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।”

তিনি আরও বলেন, মুদ্রানীতির পাশাপাশি সরবরাহ-পক্ষের দুর্বলতাও বড় ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশ আমদানি নির্ভর হওয়ায় টাকার অবমূল্যায়ন দাম বাড়িয়েছে, যা মুদ্রানীতির প্রভাবকে দুর্বল করছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২১ অর্থবছর থেকে টাকার মান মার্কিন ডলারের বিপরীতে ৪৩ শতাংশ কমে গেছে, যার কারণে আমদানির খরচ বেড়েছে এবং অভ্যন্তরীণ বাজারে সরাসরি প্রভাব পড়েছে। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ২০২৪ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বরের ভয়াবহ বন্যার কারণে সরবরাহ ব্যবস্থা আরও দুর্বল হয়ে পড়েছে, যা খাদ্যপণ্যের দাম অস্থির করেছে।

ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, “আমাদের বাজার প্রতিযোগিতামূলক নয়। কৃষক যে দামে পণ্য বিক্রি করে, ভোক্তা তা অনেক বেশি দামে কিনতে হয়। বাজারে অস্বচ্ছতা ও সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণের কারণে নীতিমালার সুফল ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছায় না।”

যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্কের অর্থনীতির অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ বিরুপাক্ষ পাল এ পরিস্থিতিকে ‘নীতিগত দ্বৈততা’ আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেন, “একদিকে সুদের হার বাড়িয়ে মুদ্রা সংকোচনের চেষ্টা হচ্ছে, আবার অন্যদিকে ব্যাংক খাতে তরলতা বাড়াতে টাকা ছাপানো হচ্ছে। এর ফলে মুদ্রাস্ফীতি আরও বেড়ে যাচ্ছে।”

বাংলাদেশ ব্যাংক জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাজার থেকে ১.৭ বিলিয়ন ডলার কিনেছে, যার অর্থ স্থানীয় মুদ্রা ছাপিয়ে প্রদান করা হয়েছে। এর ফলে বাজারে অতিরিক্ত টাকার প্রবাহ তৈরি হয়েছে।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. আশিকুর রহমান জানান, গত এক বছরের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বিনিয়োগ স্থবিরতাও মুদ্রাস্ফীতির পেছনে একটি বড় কারণ। তিনি বলেন, “বাজারে পণ্যের সরবরাহ ব্যাহত হয়েছে, টাকার মান কমেছে। ফলে উৎপাদন ও আমদানির খরচ বেড়েছে।” তিনি আশা প্রকাশ করেন, আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের পর রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরলে সরবরাহের সমস্যা কমে মুদ্রাস্ফীতিও কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসবে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ইতোমধ্যেই সতর্ক করে দিয়েছে, “টাকার অবমূল্যায়ন এবং যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য পাল্টা শুল্ক আরোপের কারণে ২০২৫-২৬ অর্থবছরেও দাম বাড়তে পারে।” সিপিডির ড. ফাহমিদা খাতুনও মনে করেন, সরকারি কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি এবং নির্বাচনী সময় অতিরিক্ত ব্যয় মুদ্রাস্ফীতি বাড়াতে পারে। তিনি বলেন, “২০২৬ সালেও স্বস্তি পাওয়া কঠিন হবে। দাম নিয়ন্ত্রণ বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে থাকবে।”

অন্যদিকে, প্রতিবেশী দেশ ভারতে ২০২৫ সালের আগস্টে বার্ষিক ভোক্তা মুদ্রাস্ফীতি ছিল মাত্র ২.০৭ শতাংশ, যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন। ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বারবার জানিয়েছে, তারা মুদ্রাস্ফীতি ৪ শতাংশের নিচে রাখতে সক্ষম হয়েছে। খাদ্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিশেষ করে দুধ, গম ও শাকসবজির দাম কম থাকার ফলে ভোক্তা সূচক নিম্নমুখী হয়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, উৎপাদনশীল কৃষি নীতি, যথাযথ ভর্তুকি ও দ্রুত বাজার সরবরাহের কারণে ভারত দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে স্থিতিশীল অর্থনীতিগুলোর মধ্যে অন্যতম।

পাকিস্তানে সেপ্টেম্বরে মুদ্রাস্ফীতি ছিল ৫.৬ শতাংশ, যা সাম্প্রতিক বছরগুলোর তুলনায় উন্নতি হলেও বিদেশি মুদ্রার সংকট, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং কর বৃদ্ধির কারণে ক্রয়ক্ষমতা ঠিকঠাক বৃদ্ধি পাচ্ছে না।

নেপালে মুদ্রাস্ফীতি ৫.২ শতাংশে অবস্থান করছে। খাদ্য ও পোশাক খাতে দাম কিছুটা বেড়েছে, তবে আমদানিকৃত পণ্যের দাম কমার কারণে চাপ কিছুটা কম। দেশটি ভারতের পাশাপাশি চীন থেকে পণ্য আমদানি করে, তাই প্রতিবেশী দেশগুলোর মূল্যস্তর প্রভাব ফেলছে। নেপালের কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থ সরবরাহ সীমিত করে দাম স্থিতিশীল রাখতে চেষ্টা করছে।

অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পর শ্রীলঙ্কা পুনরুদ্ধারে সফল হয়েছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে শ্রীলঙ্কার মুদ্রাস্ফীতি ১.৫ শতাংশে নেমে এসেছে, যেখানে ২০২২ সালে তা ৫০ শতাংশের বেশি ছিল। কঠোর মুদ্রানীতি, বাজেট ঘাটতি কমানো এবং আন্তর্জাতিক ঋণ পুনর্গঠনের মাধ্যমে দেশটির অর্থনীতি ধীরে ধীরে স্থিতিশীল হচ্ছে।

ভুটান ও মালদ্বীপেও মাঝারি স্তরের মুদ্রাস্ফীতি বিরাজ করছে। ভুটানে মুদ্রাস্ফীতি গড়ে ৪-৫ শতাংশের মধ্যে, যেখানে সরকারি ভর্তুকি দাম নিয়ন্ত্রণে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। মালদ্বীপে পর্যটন খাত পুনরুদ্ধারের পর দাম তুলনামূলক স্থিতিশীল রয়েছে। ২০২৫ সালের মাঝামাঝি মালদ্বীপের মুদ্রাস্ফীতি প্রায় ৩ শতাংশ, যা দক্ষিণ এশিয়ার গড়ের নিচে।

ঢাকাওয়াচ২৪ডটকমে লিখতে পারেন আপনিও ফিচার, তথ্যপ্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, ভ্রমণ ও কৃষি বিষয়ে। আপনার তোলা ছবিও পাঠাতে পারেন [email protected] ঠিকানায়।
×