এ মুহূর্তে বিনিয়োগ প্রত্যাশা করা অবাস্তব: গভর্নর
- নিজস্ব প্রতিবেদক
- প্রকাশঃ ০৭:২৬ পিএম, ১০ আগস্ট ২০২৫

রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং নিরাপত্তা ঘাটতির মধ্যে দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়ে বাস্তবসম্মত দৃষ্টিভঙ্গির আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। তাঁর মতে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে বড় ধরনের বিনিয়োগের আশা করা অবাস্তব ও কল্পনাপ্রসূত।
রবিবার (১০ আগস্ট) ঢাকার গুলশানে এক হোটেলে আয়োজিত ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ৩৬৫ দিন’ শীর্ষক সংলাপে তিনি এসব মন্তব্য করেন। সংলাপটি আয়োজন করে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। এতে সভাপতিত্ব করেন সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান এবং প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন।
বিনিয়োগ এখনও ঝুঁকিপূর্ণ
গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, দেশে কেবলমাত্র আর্থিক খাতে কিছুটা স্থিতিশীলতা ফিরেছে, তবে রাজনৈতিক অঙ্গনে তা এখনও অনুপস্থিত। নিরাপত্তা পরিস্থিতিও অনিশ্চিত। ফলে কেউ যদি আশা করেন এই মুহূর্তে বিনিয়োগকারী হুমড়ি খেয়ে পড়বে, সেটি তিনি অবাস্তব মনে করেন।
"আমাকে বাস্তবসম্মত হতে হবে," বলেন গভর্নর।
তিনি আরও বলেন, বিনিয়োগের কিছু প্রস্তুতি রয়েছে এবং কিছু ইতিবাচক ইঙ্গিতও পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু সময় এখনও অনুকূলে নয়। সামনে নির্বাচন, ফলে বড় বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সবাই অপেক্ষায় আছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও স্বাভাবিকভাবেই পরবর্তী সরকারের নীতির দিকেই তাকিয়ে থাকবেন।
"লেটস টক টু দ্য নেক্সট গভর্মেন্ট, এটা খুব স্বাভাবিক পলিটিক্যাল প্রসেস," — মন্তব্য করেন তিনি।
আমদানি-রপ্তানির বাস্তবতা
গভর্নর জানান, এখনো প্রতি মাসে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হচ্ছে। বাজারে কোনো ঘাটতির লক্ষণ নেই। কিন্তু মূল প্রশ্ন হলো, এই পরিস্থিতিতে বিনিয়োগ করবে কে?
“দ্য আনসার ইজ হু ইজ গোয়িং টু ইনভেস্ট ইন দিস এনভারনমেন্ট (এখন এখানে কে বিনিয়োগ করবে?)” — বলেন তিনি।
তিনি বলেন, আমরা খাদের কিনারায় ছিলাম, এখন যদি দ্রুত ফেরত না আসা যায়, তাহলে ধ্বংস অনিবার্য।
দুই বড় চ্যালেঞ্জের কথা
গভর্নরের মতে, দেশের সামনে দুটি বড় চ্যালেঞ্জ— সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা এবং প্রয়োজনীয় নীতিগত সংস্কার বাস্তবায়ন। এর মাধ্যমে ভবিষ্যতের সরকার যেন টেকসই উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারে, সেই ভিত্তি তৈরির লক্ষ্যেই তারা কাজ করছেন।
এক বছর পর মূল্যায়নের সময় এসেছে
সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার এক সপ্তাহ পরই তারা আলোচনা করেছিলেন বর্তমান সরকারের কাছে কি প্রত্যাশা থাকবে। সেই সময় অর্থনীতি ছিল অত্যন্ত সংকটপূর্ণ অবস্থায়। রিজার্ভ কমে যাচ্ছিল, মুদ্রার মান পড়ে যাচ্ছিল, মূল্যস্ফীতি, বেকারত্ব বাড়ছিল।
তিনি বলেন, "এখন এক বছর পর ফিরে তাকালে আমরা দেখতে পাচ্ছি, মূল্যায়নের প্রয়োজনীয়তা সামনে এসেছে।"
তিনি আরও বলেন, ব্যাংকিং খাতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার প্রয়াস দেখা যাচ্ছে। রাজনৈতিক নেতারা গোষ্ঠীগতভাবে জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটান—এমন আশাও ব্যক্ত করেন তিনি।
মানিলন্ডারিং বন্ধ হওয়ায় রেমিট্যান্স বেড়েছে
সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী ও বিএনপি নেতা আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী জানান, মানিলন্ডারিং বন্ধ হয়ে যাওয়ায় রেমিট্যান্স ও রপ্তানি দুই-ই বেড়েছে। তিনি বলেন, “যারা লন্ডারিং করতো তারা তো পালিয়ে গেছে। যারা দেশে আছে তাদের হাতে টাকা নেই।”
তবে তিনি মনে করেন, বাজেট প্রণয়নে সমাজকেন্দ্রিক পরিকল্পনার ঘাটতি ছিল। “আমি মনে করি এটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল,” — মন্তব্য করেন তিনি।
৩৬৫ দিনে কোনো অলৌকিক পরিবর্তন দেখিনি: বিটিএমএ সভাপতি
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল গভর্নরের বক্তব্যকে স্মরণ করিয়ে বলেন, গার্মেন্টস খাত সংকট মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও সরকারের কাছ থেকে তেমন কোনো সহায়তা তারা পাননি। “গত ৩৬৫ দিনে ম্যাজিক্যাল আমি কিছু দেখতে পাইনি,” — বলেন তিনি।
তিনি অভিযোগ করেন, টেক্সটাইল খাতে কর্পোরেট ট্যাক্স বাড়িয়ে ১৫% থেকে ৩৭% করা হয়েছে, অথচ ফিনিশড প্রোডাক্ট আসছে শুল্ক ছাড়াই। কাঁচামাল তুলার উপর ২% শুল্ক এবং গ্যাস-বিদ্যুৎ ঘাটতি মিলিয়ে খাতটি চাপে রয়েছে।
তিনি বলেন, দক্ষ জনশক্তি তৈরির জন্য কোনো ট্রেনিং সেন্টার হয়নি, অথচ মালয়েশিয়ায় ভারতীয় শ্রমিকেরা ভালো বেতনে কাজ করছে। তার দাবি, ১৮৫০টি ফ্যাক্টরি থাকলেও, নতুন কোনো কারখানা হয়নি বরং কিছু বন্ধ হয়েছে।
ব্যাংক লুটপাট নিয়ে ক্ষোভ
ব্যাংক খাতে দুর্নীতি নিয়ে গভীর অসন্তোষ প্রকাশ করেন শওকত আজিজ রাসেল। তিনি প্রশ্ন রাখেন— যে ব্যাংকগুলো লুটপাটের মাধ্যমে দুর্বল হয়েছে, তাদের কেন আবার টাকার জোগান দেওয়া হচ্ছে?
“চোরগুলোকে কেন টাকা দিচ্ছেন?” — প্রশ্ন করেন তিনি।
তার মতে, এসব ব্যাংক বন্ধ করে ভালো ব্যাংকের শাখা বাড়ানোই উচিত ছিল।
চাঁদাবাজির ছোবলে অর্থনীতি
বাসদের কেন্দ্রীয় সহকারী সাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় চাঁদাবাজি গভীরভাবে প্রভাব ফেলেছে। তিনি উল্লেখ করেন—“বছরে ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার চাঁদাবাজি হয়।”
তিনি বলেন, একদা সমালোচক হলে স্বাধীনতাবিরোধী বলা হতো, এখন ফ্যাসিবাদের দোসর তকমা দেওয়া হয়। “একই পদ্ধতিতে রাষ্ট্র চালিয়ে ভিন্ন ফল আশা করা যায় না,” — মন্তব্য করেন তিনি।