বিসিবিতে দুদকের হানা, মিলেছে দুর্নীতির প্রমাণ


April 2025/BCB ACC.jpg

বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) বিরুদ্ধে তিনটি অভিযোগের সত্যানুসন্ধানে গতকাল মঙ্গলবার (১৫ এপ্রিল) দুপুরে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে বিসিবি কার্যালয়ে অভিযান পরিচালনা করেন দুদক কর্মকর্তারা। তৃতীয় বিভাগ বাছাই টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ ফি ৭৫ হাজার থেকে বাড়িয়ে পাঁচ লাখ টাকা করা, বিপিএলের টিকিট বিক্রিতে অসামঞ্জস্য এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনে কনসার্ট আয়োজন করে অর্থ লোপাট করার অভিযোগের ভিত্তিতে সরেজমিন তদন্তে নেমেছে দুদক। সেখানে বিপিএলের টিকিট বিক্রি ও তৃতীয় বিভাগ বাছাই লিগে অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রাথমিক প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অভিযান পরিচালনা শেষে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানায় সংস্থাটি। 

দুদকের বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে, একাদশ বিপিএলে ১৩ কোটি টাকার টিকিট বিক্রি হলেও তৃতীয় থেকে দশম বিপিএলে ১৫ কোটি টাকা আয় দেখানো হয়েছে, যা বিগত বিপিএলগুলোতে ব্যাপক আর্থিক অনিয়মের ইঙ্গিত বহন করে বলে সন্দেহ তদন্ত-সংশ্লিষ্টদের। দুদক জানায়, “ক্রিকেট সেলিব্রেট মুজিব ১০০” বাস্তবায়নে ২৫ কোটি ৩৮ লাখ টাকা খরচ দেখানো হলেও প্রকৃতপক্ষে মাত্র ৭ কোটি টাকা খরচ হয়েছিল- এমন তথ্য পায় দুদক টিম। এক্ষেত্রে প্রায় ১৯ কোটি টাকার আর্থিক অনিয়মের তথ্য প্রাথমিকভাবে পাওয়া যায়। অভিযানকালে অভিযোগগুলোর প্রাথমিক সত্যতার পরিপ্রেক্ষিতে অধিকতর যাচাইয়ের লক্ষ্যে রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করা হয়েছে। রেকর্ডপত্র যাচাই-বাছাই করে কমিশন বরাবর প্রতিবেদন দেওয়া হবে বলে জানায় সংস্থাটি। বিগত বছরগুলোতে তিন-চারটি নামসর্বস্ব ক্লাবের আবেদন দেখিয়ে বাছাই লিগে দুর্নীতি ও অনিয়ম হওয়ার প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে বলে জানায় দুদক।

বিসিবির সভাপতি ও বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ বিপিএল শেষে সংবাদ সম্মেলনে জানান, বিগত আট বছরে টিকিট বিক্রি থেকে আয়ের অসামাঞ্জস্য খতিয়ে দেখা হবে। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে অভ্যন্তরীণ তদন্তের উদ্যোগও নেন তিনি। 

দুদকের সহকারী পরিচালক আল আমিন বলেন, ‘আগে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণে অর্থ নিয়ে টিকিটের ব্যাপারে চুক্তি করা হতো। তারা টিকিট বিক্রি করে বিসিবিকে একটি অংশ দিত। গত ৩-৪ আসরে বিসিবি নিজ থেকে টিকিট বিক্রি করছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে একাদশ আসরে আমরা দেখেছি, ১৩ কোটি টাকা আয় হয়েছে। আট বছরে যেখানে ১৫ কোটি, এক বছরেই ১৩ কোটি। রেকর্ডপত্র আমরা পেয়েছি। বিস্তারিত যাচাই করলেই বোঝা যাবে কী অসংগতি এখানে।’ বিপিএলের টিকিট ব্যাংক, অনলাইন এবং অভ্যন্তরীণভাবে বিক্রি হতো। বেশি টিকিট বিক্রি হতো ভাউচার দিয়ে অভ্যন্তরীণভাবে। বিসিবির অ্যাকাউন্টস বিভাগ নগদ অর্থ নিয়ে টিকিট বিক্রির দায়িত্ব পালন করেছে। অভিযোগ আছে, অভ্যন্তরীণ শাখা থেকে বিক্রি করা টিকিটের টাকা বোর্ডের কোষাগারে জমা হতো না। এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত একজন কর্মকর্তা রাজসাক্ষী হতে পারেন বলে জানা গেছে।’ 

তৃতীয় বিভাগ বাছাই টুর্নামেন্টের ফি ৭৫ হাজার থেকে বাড়িয়ে পাঁচ লাখ টাকা করার পেছনে অসৎ উদ্দেশ্য থাকার শঙ্কা প্রকাশ করেছেন দুদক কর্মকর্তারা। মূলত ২০১৪-১৫ মৌসুমে অংশগ্রহণ ফি পাঁচ লাখ টাকা করা হলে একাডেমিগুলোর অংশগ্রহণ ব্যাপকহারে কমে যায়। পাঁচ থেকে সাতটি একাডেমি নিয়ে হয়েছে বাছাই লিগ। বিসিবির পট পরিবর্তনের পর বর্তমান সভাপতি ফারুক আহমেদ অংশগ্রহণ ফি এক লাখ টাকা করায় ৬০টি একাডেমি নিবন্ধন করে। বাছাই লিগের আবেদন ফি বাড়িয়ে দলের অংশগ্রহণ কমার পেছনে বোর্ডের বা ব্যক্তিগত কোনো প্রভাব ছিল কিনা সেটি খতিয়ে দেখা হবে- জানান আল আমিন। 

তিনি বলেন, ‘তৃতীয় বিভাগ বাছাই লিগে এবার ৬০টি দল অংশ নিয়েছে। আগে ২-৩ বা সর্বোচ্চ ৪ দলের লিগ হতো। এখানে হয়তো কোনো কারণ আছে। আমরা কাগজপত্র সংগ্রহ করেছি, এক্ষেত্রে ব্যক্তিগত বা বোর্ডের কোনো প্রভাব ছিল কিনা দেখার জন্য। এমনিতেই বোঝা যাচ্ছে, আগে হয়তো অংশগ্রহণের স্বাধীনতা ছিল না, কোনো চাপ ছিল। যে কারণে দলগুলো আসত না। আমরা বিস্তারিত যাচাই-বাছাই করে বুঝতে পারব এখানে কী অসংগতি ছিল।’

২০২০-২১ সালে মুজিব শতবর্ষ উদযাপনে কনসার্টের আয়োজন করে বিসিবি। ওই আয়োজনে ব্যয়ের হিসাবে গরমিল রয়েছে বলে জানান আল আমিন। তার মতে, ‘মুজিব শতবর্ষের ব্যয়ের হিসাবে কিছু অস্বাভাবিকতা আছে। এসব অভিযোগের বিষয়ে রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করা হয়েছে। সেগুলো যাচাই-বাছাই করে আমরা আমাদের এনফোর্সমেন্ট ইউনিটে প্রতিবেদন দাখিল করব। সেই অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপের ব্যাপারে কমিশন সিদ্ধান্ত নেবে।’ দুদকে জমা হওয়া অভিযোগে বলা হয়েছে, ২৫ কোটি টাকা খরচ দেখিয়ে অর্থ লোপাট করা হয়েছে। আল আমিনের মতে, ‘কনসার্টসহ যে আয়োজন হয়েছিল, সেখানে সব মিলিয়ে ২৫ কোটি টাকা খরচ দেখানো হয়েছে। আমরা এই অভিযোগ পেয়েছি। আসলে খরচ হয়েছে ৭ কোটি টাকার মতো। এখানে প্রায় ১৯ কোটি টাকা সরানো হয়েছে বা কিছু হয়েছে। এরকম অভিযোগ আমরা পেয়েছি।’ বিসিবির কাছে খরচের সকল রেকর্ডের তথ্য চেয়েছেন কর্মকর্তারা। তিনি বলেন, ‘বিসিবির অর্থ বিভাগের কাছ থেকে কাগজপত্র চেয়েছি। কিছু কাগজ পর্যালোচনায় আমরা বুঝতে পেরেছি, এখানে প্রায় ১৯ কোটি টাকার হিসাবে অস্বাভাবিকতা আছে। এছাড়া টিকিট বিক্রির ২ কোটি টাকাও এখানে দেখানো হয়নি। তাই এখানে টাকা আত্মসাতের পরিমাণ আরও বাড়তে পারে। আমরা এখনও নিশ্চিত হতে পারিনি। সব কাগজপত্র হাতে পেলে সুনির্দিষ্ট করে আমরা বলতে পারব।’

দুদক পরিচালিত দেড় ঘণ্টার অভিযানে কর্মকর্তাদের সঙ্গে ছিলেন বিসিবির সিইও নিজাম উদ্দিন চৌধুরী। তদন্ত কমিটিকে সর্বাত্মক সহযোগিতা এবং ডকুমেন্টস সরবরাহ করা হবে বলে জানান তিনি। 

সিইও বলেন, ‘যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, এ সবের ব্যাপারে আমাদের কাছে যত কাগজপত্র আছে, সব বিভাগকে সেগুলো দুদকের কাছে দিয়ে সহযোগিতার জন্য বলে দেওয়া হয়েছে। আমাদের দিক থেকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করা হবে। এখন যেহেতু অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করা হচ্ছে, তাই এর বেশি কিছু বলা উচিত হবে না।’ 

গতকাল মঙ্গলবার বিকেল দুদকের চাহিদা মতো কাগজপত্র রেকর্ড থেকে বের করে ফাইল করা হয়েছে বলে জানান কর্মকর্তারা। 

ঢাকাওয়াচ২৪ এর খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন ।
ঢাকাওয়াচ২৪ডটকমে লিখতে পারেন আপনিও ফিচার, তথ্যপ্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, ভ্রমণ ও কৃষি বিষয়ে। আপনার তোলা ছবিও পাঠাতে পারেন [email protected] ঠিকানায়।
×