সেন্ট মার্টিনে মার্কিন ঘাঁটির প্রশ্নে নতুন ভূ-রাজনৈতিক আলোচনায় বাংলাদেশ
- নিজস্ব প্রতিবেদক
- প্রকাশঃ ০২:১২ পিএম, ১২ অক্টোবর ২০২৫

বাংলাদেশের ছোট অথচ কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দ্বীপ সেন্ট মার্টিনে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের বিষয়টি আবারও দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক অঙ্গনে তুমুল আলোচনার জন্ম দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বঙ্গোপসাগরের এই এলাকা এখন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতের ভূ-প্রভাবের প্রতিযোগিতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
গত বছরের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ক্ষমতার পরিবর্তনের পর বাংলাদেশ এখন বৈশ্বিক শক্তিগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। যদিও অন্তর্বর্তী সরকার অবাধ নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, দেশটির রাজনীতি এখনো উত্তপ্ত এবং বিদেশি হস্তক্ষেপের অভিযোগও উঠেছে। এই প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে আলোচিত ইস্যু হয়ে উঠেছে সেন্ট মার্টিনে সম্ভাব্য মার্কিন ঘাঁটি স্থাপন।
সেন্ট মার্টিন: ছোট দ্বীপ, বড় কৌশল
মাত্র তিন বর্গকিলোমিটারের এই দ্বীপটি উত্তর-পূর্ব বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত, যা মালাক্কা প্রণালী ঘেঁষা গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক বাণিজ্য রুটের কাছে হওয়ায় অত্যন্ত কৌশলগত অবস্থান দখল করে আছে। সামরিক ও বাণিজ্যিক নজরদারির জন্য দ্বীপটি মূল্যবান একটি স্থান, এবং বিশেষজ্ঞদের মতে—যে পক্ষ সেন্ট মার্টিন নিয়ন্ত্রণ করবে, তারাই ভারত মহাসাগরের শক্তির ভারসাম্যে প্রভাব ফেলতে পারবে।
ওয়াশিংটনের জন্য এটি “Free and Open Indo-Pacific” কৌশলের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা মূলত চীনের প্রভাব মোকাবিলার পরিকল্পনা। অপরদিকে চীন ও ভারতও তাদের নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষায় এ অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারে সচেষ্ট।
হাসিনার দাবি ও মার্কিন চাপের ইঙ্গিত
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি এক বিবৃতিতে জানান, তার শাসনামলে যুক্তরাষ্ট্র সেন্ট মার্টিনে সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের প্রস্তাব দিয়েছিল। তার ভাষায়, “আমি যদি এই প্রস্তাব গ্রহণ করতাম, তাহলে পশ্চিমাদের রাজনৈতিক সমর্থন পেতাম।”
যদিও বর্তমান প্রশাসন হাসিনার এই বক্তব্য অস্বীকার করেছে, পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো বলছে, যুক্তরাষ্ট্র তার কৌশলগত স্বার্থে বাংলাদেশের রাজনৈতিক কাঠামো পুনর্গঠনের চেষ্টা করছে।
“রঙিন বিপ্লব”-এর ছায়া
আঞ্চলিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করছেন, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলীতে “রঙিন বিপ্লব”-এর আদলে পরিবর্তনের ছাপ স্পষ্ট। কোটা আন্দোলন থেকে শুরু করে ছাত্রদের প্রতিবাদ, এনক্রিপ্টেড অ্যাপের ব্যবহার, এনজিও কার্যক্রম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সহিংস ছবি প্রচার—সব মিলিয়ে ইউক্রেন, জর্জিয়া ও সার্বিয়ার অতীত আন্দোলনের কৌশলের সঙ্গে মিল খুঁজে পাচ্ছেন তারা।
তাদের মতে, ওয়াশিংটন এমন কৌশলের মাধ্যমে স্বাধীন সরকারগুলোর ওপর পরোক্ষ চাপ প্রয়োগ করে মার্কিন স্বার্থের অনুকূলে রাজনৈতিক পরিবর্তন আনতে চায়।
ড. ইউনূস: ওয়াশিংটনের পছন্দের নেতা?
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হন ড. মুহাম্মদ ইউনূস, যিনি নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে পরিচিত মুখ। পশ্চিমা বিশ্লেষকদের মতে, ক্লিনটন পরিবার ও জর্জ সোরোসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ফাউন্ডেশনগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ তাকে ওয়াশিংটনের পছন্দের নেতা হিসেবে তুলে ধরেছে।
হাসিনার সময় তার বিরুদ্ধে থাকা মামলাগুলো মার্কিন চাপেই স্থগিত হয়েছিল—এমন খবরও সে সময় প্রচারিত হয়। ফলে, তার ক্ষমতায় ফেরা অনেকেই বাংলাদেশে পশ্চিমা স্বার্থকেন্দ্রিক রাজনৈতিক পুনর্বিন্যাসের অংশ হিসেবে দেখছেন।
ভারতের শঙ্কা, চীনের সুযোগ
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিবর্তন নিয়ে ভারত ও চীন উভয়ের মধ্যেই সতর্কতা ও আগ্রহ দেখা দিয়েছে। নয়াদিল্লি, দীর্ঘদিনের মিত্র শেখ হাসিনার পতনের পর, পূর্ব সীমান্তে মার্কিন প্রভাব বৃদ্ধির আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন।
অন্যদিকে বেইজিং এই পরিস্থিতিকে সুযোগ হিসেবে দেখছে। ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’-এর অংশ হিসেবে বাংলাদেশের অবকাঠামো খাতে বিশাল বিনিয়োগের মাধ্যমে তারা দেশটিতে নিজেদের উপস্থিতি জোরদার করছে—যা ওয়াশিংটনের কৌশলগত পরিকল্পনার পাল্টা ভারসাম্য হিসেবেই দেখা হচ্ছে।
অনিশ্চিত রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ
অন্তর্বর্তী সরকার অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের আশ্বাস দিলেও বাংলাদেশ এখনো রাজনৈতিকভাবে নাজুক অবস্থায় রয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, দেশটি এখন ওয়াশিংটন, বেইজিং ও নয়াদিল্লির ত্রিমুখী প্রতিযোগিতার রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গোপসাগরে নিজের উপস্থিতি দৃঢ় করতে চায়, চীন তার বাণিজ্য রুট ও প্রভাব ধরে রাখতে সচেষ্ট, আর ভারত চেষ্টা করছে বাংলাদেশকে বিদেশি প্রভাবমুক্ত রাখার।
ফলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ এখন শুধু তার অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ওপর নির্ভর করছে না—বরং এটি সমগ্র ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক ভারসাম্যেও বড় প্রভাব ফেলবে।
সূত্র: পার্সটুডে