অবৈধ নিয়োগে ৭ বছরে ইসলামী ব্যাংকের ক্ষতি ১০ হাজার কোটি টাকা
- নিজস্ব প্রতিবেদক
- প্রকাশঃ ০২:৩৮ পিএম, ০৪ অক্টোবর ২০২৫

ইসলামী ব্যাংকের মালিকানা গ্রহণের পর এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ব্যাংকটির সেবার মান ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা এখন চরম ঝুঁকির মুখে পড়েছে। গত কয়েক বছরে কোনো নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি বা পরীক্ষা ছাড়াই অনিয়মের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৩৪০ জন। তাদের মধ্যে অনেকে ভুয়া সার্টিফিকেট ব্যবহার করে চাকরি পেয়েছেন। ইতোমধ্যে কিছু ভুয়া সনদধারীকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে, বাকিদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা চলছে। ব্যাংকটির হিসাব অনুযায়ী, শুধু অবৈধ নিয়োগ ও অনিয়মের কারণে গত সাত বছরে ক্ষতি হয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি।
ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা জানান, এস আলম গ্রুপের লুটপাটের তথ্য প্রকাশের পর থেকেই প্রতিষ্ঠানটির ভেতরে অস্থিরতা বেড়ে গেছে। চট্টগ্রামের পটিয়া অঞ্চলের বেশ কিছু অযোগ্য ব্যক্তিকে মোটা অঙ্কের বিনিময়ে চাকরি দেওয়া হয়েছিল, যাদের অনেকেই ব্যাংকিংয়ের মৌলিক যোগ্যতা রাখেন না।
সূত্র জানায়, এসব নিয়োগে শত কোটি টাকার অনিয়ম ঘটেছে। সম্প্রতি কর্মীদের দক্ষতা যাচাইয়ে বিশেষ পরীক্ষা নেওয়া হলে তা বয়কট করে সাবেক কর্মকর্তা ও চাকরিচ্যুতরা। তাদের নেতৃত্বে বিভিন্ন অপপ্রচার, আন্দোলন ও অস্থিতিশীলতা চলছে। অভিযোগ আছে, শুক্রবার ভোরে ব্যাংকের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ হ্যাক করার ঘটনাতেও এই বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা রয়েছে। হ্যাকাররা পেজের প্রোফাইল ও কভার ছবি পরিবর্তন করে হুমকিমূলক বার্তা প্রকাশ করে।
ব্যাংক সূত্রের তথ্যমতে, বিদ্রোহী ও অবৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত কিছু কর্মীর কারণে ভল্ট ও ক্যাশ কাউন্টারের নিরাপত্তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। তাদের অনিয়ন্ত্রিত আচরণ এবং অতিরিক্ত সুবিধা দাবি ব্যাংকের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকেও হুমকিতে ফেলছে।
কর্মকর্তাদের আশঙ্কা, কিছু বিদ্রোহী কর্মী সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে উসকানি দিচ্ছে এবং প্রয়োজনে ব্যাংকের ভল্ট বা ক্যাশ কাউন্টারে হামলার চেষ্টা করতে পারে।
অভ্যন্তরীণ এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এস আলম গ্রুপের নামে-বেনামে ব্যাংক থেকে তোলা অর্থের পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। পাশাপাশি অবৈধ নিয়োগ ও অনিয়মের কারণে গত সাত বছরে ক্ষতির অঙ্ক ছাড়িয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা। এসব অর্থ পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়া বর্তমানে চলছে।
অভিযোগ রয়েছে, এস আলমের নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের অব্যবস্থাপনা ও আচরণ ব্যাংকের সেবা মানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। গ্রাহকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, আঞ্চলিক ভাষায় যোগাযোগ ও সেবা প্রদানে গাফিলতি—এসব কারণে গ্রাহক অসন্তোষ দিন দিন বাড়ছে।
চাকরিচ্যুত এক কর্মকর্তা বলেন, “আমি কুড়িগ্রামের রকমারি শাখায় কর্মরত ছিলাম। কোনো কারণ ছাড়াই আমাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এখনো অনেক অযোগ্য কর্মী ব্যাংকে রয়েছেন। তবে ভবিষ্যতে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার দায় আমরা নেব না।”
বিশ্লেষকরা মনে করেন, এস আলম শুধু ইসলামী ব্যাংক নয়, পুরো ব্যাংকিং খাতকেই অস্থিতিশীল করে তুলেছে। তাদের মতে, ইসলামী ব্যাংককে পুনরায় স্বচ্ছ ও শক্ত অবস্থানে ফিরিয়ে আনতে হলে বড় ধরনের সংস্কার এবং ব্যয় নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশ (এবিবি)-এর চেয়ারম্যান ও সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন বলেন, “এস আলম একাই ব্যাংক খাতের জন্য বড় সমস্যা তৈরি করেছে। ইসলামী ব্যাংককে টিকিয়ে রাখতে উন্নত ব্যবস্থাপনা ও ব্যয় হ্রাস নিশ্চিত করা প্রয়োজন।”
ব্যাংকের পাবলিক রিলেশন ও ব্র্যান্ডিং বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, বিদ্রোহী কর্মীদের মনোভাব ও অনির্দিষ্ট আমানত ব্যবস্থাপনার কারণে ব্যাংকের ভল্ট ও ক্যাশ কাউন্টার ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। দ্রুত সিদ্ধান্ত না নিলে ঝুঁকি আরও বাড়বে বলেও তিনি সতর্ক করেন।
এদিকে সমাজের বিভিন্ন মহলে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। গ্রাহক আমিনুল ইসলাম তার ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, “পটিয়ার অবৈধ নিয়োগপ্রাপ্তরাই এখন চাকরি রক্ষার আন্দোলন করছে। কিন্তু যিনি কোটি কোটি টাকা পাচার করেছেন, সেই ডাকাত সর্দার এস আলমের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করে না কেন?”
ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, অফিসিয়াল পেজ হ্যাকসহ সব ধরনের হুমকি ও নিরাপত্তা ইস্যুর তদন্ত চলছে। গ্রাহক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।