ব্যাংকের টাকা লোপাটকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে: ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী


ব্যাংকের টাকা লোপাটকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে: ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী

অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী জানিয়েছেন, গত ১৬ বছরে ব্যাংকের টাকা লোপাটের ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে এবং কেউ ছাড় পাবে না। তিনি বলেন, অর্থ পাচার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি অব্যাহত রয়েছে।

রবিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) সচিবালয়ে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থাকে (বাসস) দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী এই কথা বলেন। তিনি বলেন, "আপনারা দেখেছেন এরই মধ্যে ব্যাংকের টাকা লোপাটকারীদের অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকীদেরকেও নজরদারীতে রাখা হয়েছে।"

তিনি জনতা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আবুল বারাকাতের নাম উল্লেখ করে জানান, "উনাকে এখন অন্য মামলায় আটক করা হয়েছে। কিন্তু অচিরেই তার আর্থিক অনিয়মের বিষয়েও মামলা হবে।"

ড. আনিসুজ্জামান বলেন, “বারাকাত সাহেবের আমলে জনতা ব্যাংক থেকে যেসব লোন হয়েছে সেগুলো সরকারের বিবেচনায় আছে। প্রত্যেকটি টাকার হিসাব নেওয়া হবে। যাদের অনিয়ম দুর্নীতির কারণে আর্থিক খাতে বিশাল অপরাধ সংগঠিত হয়েছে তাদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবেনা।”

তিনি আরও জানান, শুধু জনতা ব্যাংক নয়, অন্যান্য ব্যাংকগুলোর অনিয়ম নিয়েও সরকার নজর রাখছে এবং সময়মতো দেশের জনগণকে এসব বিষয়ে অবহিত করা হবে।

প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী বলেন, আর্থিক খাতের অনিয়মের বিষয়ে মামলাগুলোতে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টেশন অনেক সময় নেয়, তাই এখন পর্যন্ত টাকা পাচার বা লুটপাটের সঙ্গে জড়িতদের অন্য মামলায় আটক করা হলেও তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ তথ্যের ভিত্তিতে দ্রুতই টাকা আত্মসাতের মামলা করা হবে।

টাকা পাচার রোধে সরকার বিভিন্ন দেশের সঙ্গে মিউচ্যুয়াল লিগ্যাল এসিসটেন্স চুক্তি করছে বলে তিনি জানান। "আমরা এমন আইন করে যাব, যাতে আগামীতে বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচার করতে গেলে দশবার চিন্তা করবে। কারণ তারা কেউই রেহাই পাবে না। কোনোভাবেই তাদের ছাড় দেওয়া হবে না।"

তিনি আরও জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের নেতৃত্বে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি এ বিষয়ে কাজ করছে।

ড. আনিসুজ্জামান বলেন, গত ১৬ বছরে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে যে পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে, তা যেখানেই থাকুক, ফিরিয়ে আনার সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে। তবে প্রত্যেক দেশের সঙ্গে আলাদা চুক্তির কারণে সময় কিছুটা লেগে যাচ্ছে।

তিনি উল্লেখ করেন, সুইজারল্যান্ড, আবুধাবি, কাতার, দুবাই, সিঙ্গাপুর, আমেরিকা, কানাডা ও যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশের আইন ও নিয়মনীতি আলাদা। অনেক দেশ নাগরিকত্ব বা স্থায়ী বসবাসের সুযোগ দিয়ে পাচারকারীদের রক্ষা করছে, ফলে টাকা ফেরত আনা কঠিন হচ্ছে। এই দেশের আইন-কানুনকে ভিত্তি করে তারা সহজে অর্থ ফেরত দিতে আগ্রহী নয়।

বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শক্তি হিসেবে তিনি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে উল্লেখ করেন। "আন্তর্জাতিকভাবে তাঁর উচ্চ সম্মান ও মর্যাদা রয়েছে। তিনি যখন বাংলাদেশ নিয়ে সহায়তা চাইবেন, কোন দেশ তা প্রত্যাখ্যান করতে পারবে না। এটাই আমাদের বড় অস্ত্র।"

অর্থনীতিবিদ ড. আনিসুজ্জামান বলেন, সাধারণত কোনো দেশে বিপ্লবের কারণে ক্ষমতার পরিবর্তন হলে জিডিপি কমে, বেকারত্ব বাড়ে এবং মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়। কিন্তু আল্লাহর রহমতে বাংলাদেশে এমন পরিস্থিতি হয়নি।

তিনি বলেন, “বিপ্লবের ফলে নতুন সরকারের সময় জিডিপি নেগেটিভে চলে গেলে বেকারত্ব বেড়ে যায় এবং মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। অন্যদিকে দারিদ্র্য বেড়ে মৃত্যু ও আত্মহত্যার হার বাড়ে। কিন্তু বাংলাদেশে এসবের একটিও ঘটেনি। আমাদের জিডিপিও নেগেটিভ হয়নি।”

তিনি স্বীকার করেন যে প্রবৃদ্ধির হার কিছুটা কমেছে, তবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক দল সফল রয়েছে। “আমরাই একমাত্র দেশ, যারা গৌরবের সঙ্গে বলতে পারব যে গণঅভ্যুত্থানের পরেও আমরা তুলনামূলক ভাল অবস্থায় আছি।”

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সংস্কার সম্পর্কে তিনি বলেন, এটি সময়োপযোগী ছিল কারণ বিশ্বের অধিকাংশ দেশে রাজস্ব নীতি প্রণয়ন ও আদায় পৃথক দুটি সংস্থার মাধ্যমে পরিচালিত হয়। বাংলাদেশে এই দুটি কাজ এনবিআর একসঙ্গে করায় স্বার্থের দ্বন্দ্ব তৈরি হচ্ছিল। এনবিআর পৃথকীকরণ তাই অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল। তিনি বলেন, “আপনি নিজে প্রসিকিউটর, নিজে জাজ, আবার নিজেই উকিল, এভাবে হয় না।”

কাস্টমস কর্মকর্তাদের দুর্নীতি ও ঘুষ গ্রহণের বিষয়ে ড. আনিসুজ্জামান বলেন, এসব কেবল আইন প্রয়োগের মাধ্যমে বন্ধ করা সম্ভব নয়, কর্মকর্তাদের নিয়োগ ও পদোন্নতিতে সতর্কতা অবলম্বন এবং নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।

অর্থ খাতের সংস্কার কার্যক্রম চলমান আছে এবং শিগগিরই এর ফলাফল দেশবাসী দেখতে পাবেন বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণের পর দেশের ওষুধের দাম বৃদ্ধি পাবে বলে যে উদ্বেগ রয়েছে, তা বাস্তবসম্মত নয় বলে ড. আনিসুজ্জামান মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, “যেসব ওষুধ বাংলাদেশে তৈরি হয় না, সেগুলোর সঙ্গে এলডিসি উত্তরণের সম্পর্ক তেমন নেই। কারণ দেশের উৎপাদিত ওষুধের প্রায় ৮৫ শতাংশ জেনেরিক, অর্থাৎ মেধাস্বত্বের মেয়াদোত্তীর্ণ।”

এছাড়াও, যেসব ওষুধের মেধাস্বত্ব আছে সেগুলোর কিছু দেশে বাংলাদেশ সরবরাহকারী হিসেবে রয়েছ, যা গ্লোবাল ভ্যালু চেইনে বাংলাদেশের অবস্থানকে শক্তিশালী করছে।

জাতিসংঘের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিশনের (ইউএনএসক্যাপ) সাবেক প্রধান এই অর্থনীতিবিদ ভবিষ্যতে অর্থ পাচারকারীদের কঠোরভাবে দমন করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে বলেন, “সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ হচ্ছে, যারা ভবিষ্যতে অর্থ পাচার করবে, তাদের ঘুম হারাম করে দেওয়া। কেউ এ ধরনের কাজ করার আগে বার বার চিন্তা করবে।”

তিনি জানান, এই উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে চেয়ারম্যান করে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।

ঢাকাওয়াচ২৪ডটকমে লিখতে পারেন আপনিও ফিচার, তথ্যপ্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, ভ্রমণ ও কৃষি বিষয়ে। আপনার তোলা ছবিও পাঠাতে পারেন [email protected] ঠিকানায়।
×