যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক পরিবর্তনে তৈরি পোশাক খাতের উদ্বেগ কতটুকু কমল?
- নিউজ ডেস্ক
- প্রকাশঃ ১০:৪১ পিএম, ০২ আগস্ট ২০২৫
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছেন, বাংলাদেশ থেকে আমদানি হওয়া তৈরি পোশাকের ওপর আরোপিত অতিরিক্ত শুল্ক ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ করা হবে। এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের বৃহত্তম রপ্তানি খাত হিসেবে বিবেচিত তৈরি পোশাক খাতে কতটা স্বস্তির বাতাবরণ তৈরি করেছে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
শিল্প বিশেষজ্ঞ ও ব্যবসায়ীরা জানান, বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে এমন অন্যান্য দেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্র প্রায় একই রকম শুল্ক ধার্য করেছে। ভারতের জন্য অতিরিক্ত শুল্ক ২৫ শতাংশ থাকায় তা আপাতত বাংলাদেশের জন্য কিছুটা স্বস্তিদায়ক। তবে মূল চ্যালেঞ্জ এখন মার্কিন বাজারে আমদানি শুল্ক বৃদ্ধির কারণে পণ্যের দাম বাড়ার ফলে ক্রেতাদের চাহিদা কমে যাওয়া এবং সেই সঙ্গে উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনার উপায় খুঁজে পাওয়া।
তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের ভারসাম্যপূর্ণ শুল্ক কাঠামোর ঘোষণায় তাদের দীর্ঘ চার মাসের উদ্বেগ অনেকাংশে দূর হয়েছে।
বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, “বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যে ২০ শতাংশ শুল্ক অবধারিতভাবে আমাদের পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়াবে, যেখানে শিল্পগুলো আগে থেকেই ঊর্ধ্বমুখী উৎপাদন ব্যয়ের সঙ্গে তাল মেটাতে প্রানান্তকরভাবে যুদ্ধ করছে। এক্ষেত্রে সরকারকেও এগিয়ে আসতে হবে।”
বাংলাদেশের ব্যবসায়ী ও নীতিনির্ধারকরা এখনো চীনের ওপর যুক্তরাষ্ট্র কতটা অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করবে, সেটি বিশেষ নজরে রাখছেন। কারণ বাইডেন প্রশাসন এখনও চীনের পণ্যের ওপর পূর্বের শুল্ক বহাল রেখেছে।
উল্লেখ্য, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে মার্কিন ও চীনের মধ্যে পাল্টাপাল্টি শুল্ক ১০০ শতাংশের ওপরে পৌঁছেছিলো।
অর্থনীতিবিদ মোস্তাফিজুর রহমান মন্তব্য করেন, “এ ধরনের শুল্ক বিশ্ব অর্থনীতি ও বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। চীনের ওপর শুল্কের মাত্রাও গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে।”
গত বৃহস্পতিবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের ওপর চূড়ান্ত শুল্ক হার ঘোষণা করেন। এর ফলে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আরোপিত শুল্ক ৩৫ শতাংশ থেকে কমে ২০ শতাংশে নেমেছে। এই শুল্ক কার্যকর করার সময়সীমাও এক সপ্তাহ বাড়িয়ে ৭ আগস্ট নির্ধারণ করা হয়েছে।
গত এপ্রিল মাসে ৩৭ শতাংশ শুল্ক ধার্য করার পর জুলাইয়ে তা ৩৫ শতাংশে নামানো হয়েছিল। বিজিএমইএ জানায়, এর আগে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পণ্যে ১৬.৫ শতাংশ শুল্ক দিতে হতো, এখন অতিরিক্ত ২০ শতাংশ শুল্ক যোগ হওয়ার ফলে মোট শুল্ক দাঁড়িয়েছে ৩৬.৫ শতাংশে, যা পণ্যের ধরন অনুযায়ী বিভিন্ন মাত্রায় প্রযোজ্য হবে।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে চীনের পর বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক হিসেবে বাংলাদেশ তার অবস্থান ধরে রেখেছে। আর রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য মতে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার, যেখানে রপ্তানির ৮৬ শতাংশের বেশি তৈরি পোশাকই।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে ৭.৫৪ বিলিয়ন ডলার। তবে এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্র ‘লিবারেশন ডে ট্যারিফ’ নামে নতুন শুল্ক ঘোষণা করলে বাংলাদেশসহ প্রতিযোগী দেশগুলোতে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে। তখন ভারতের ওপর ২৬ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়া ৩২ শতাংশ, পাকিস্তান ৩০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়।
এরপর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় বসা হয় এবং ব্যবসায়ীদেরও আলোচনায় যুক্ত করা হয়। বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক কমানোর এই পদক্ষেপ ব্যবসায়ীদের উদ্বেগ অনেক কমিয়েছে। তিনি বলেন, “তবে আলোচনা চলমান থাকবে, কারণ যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ নির্বাহী আদেশে বলা হয়েছে কিছু দেশের সঙ্গে বাণিজ্য ও নিরাপত্তা চুক্তি আলোচনা অব্যাহত রয়েছে, যার ফলে শুল্ক আরও কমতে পারে।”
বিজিএমইএ’র পরিচালক ফয়সাল সামাদ বলেন, “ভারত থেকে শুল্ক কমায় এবং ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, পাকিস্তানের কাছাকাছি শুল্কে আসায় আপাতত স্বস্তি রয়েছে। তবে এখন ক্রেতাদের সাড়া কেমন হবে, দাম কমানোর চাহিদা আসবে কি না, সেটাই দেখতে হবে। ক্রেতাদের সঙ্গে দরকষাকষি এখন বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে।”
ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, গত কয়েক বছরে উৎপাদন খরচ বেড়েছে, এবং এখন যুক্তরাষ্ট্রের অতিরিক্ত শুল্ক এসে তা আরও বাড়িয়েছে। সামাদ আরও বলেন, “২০ শতাংশ শুল্কে সুরাহা হওয়াটা একটি সুযোগও হতে পারে, যা কাজে লাগালে বাজার সম্প্রসারণ সম্ভব।”
বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের শুল্ক বিষয়ে বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বীদের তুলনায় উদ্বেগ কম, তবে চীনের ওপর শুল্ক বিষয়ে এখনও অনিশ্চয়তা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র চীনের ওপর উচ্চ শুল্ক বজায় রেখেছে, যা বাড়লে ক্রয়াদেশ কিছুটা বাংলাদেশে আসার সম্ভাবনা রয়েছে।
অর্থনীতিবিদ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “চীনের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে অনিশ্চয়তা এবং মার্কিন বাজার সংকুচিত হওয়ার শঙ্কা এখনও আছে। শুল্ক বৃদ্ধির কারণে আমেরিকায় একটি শার্টের দাম ১.৫ ডলার থেকে সাড়ে ৩ ডলার হতে পারে, যা চাহিদা হ্রাস করতে পারে।”
বিজিএমইএ মনে করে, বাংলাদেশের মার্কিন রপ্তানির প্রায় ৭৫ শতাংশই তুলাভিত্তিক পোশাক, যা ব্যবহার করে শুল্ক ছাড়ের সম্ভাবনা রয়েছে। মাহমুদ হাসান বলেন, “যদি আমেরিকার কাঁচামাল কমপক্ষে ২০ শতাংশ ব্যবহার হয়, তাহলে ওই কাঁচামালের ওপর অতিরিক্ত ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে না।”
তবে তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা স্বীকার করছেন, শুল্কের বাধা কাটিয়ে খাতকে এগিয়ে নিতে হলে নতুন বাজারে প্রবেশ, পণ্যে বৈচিত্র্য, ডিজাইন ও উদ্ভাবনে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। পাশাপাশি ছোট ও মাঝারি শিল্পের রক্ষা নিশ্চিত করতে সরকারের নজরদারির প্রয়োজনীয়তাও তারা উল্লেখ করেছেন।
সরকার আগে জানিয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় পোশাক খাত রক্ষা তাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার।
গতকাল শুক্রবার প্রেস উইং থেকে জানানো হয়েছে, বাংলাদেশ ২০ শতাংশ শুল্ক পেয়েছে, যা অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের (যেমন শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম, পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়া) শুল্কের সমতুল্য। এতে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির প্রতিযোগিতা অটুট থাকবে।
জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও প্রতিনিধি দলের প্রধান আলোচক ড. খলিলুর রহমান বলেছেন, “আমরা সম্ভাব্য ৩৫ শতাংশ শুল্ক থেকে রেহাই পেয়েছি। এটি আমাদের পোশাক শিল্প ও লক্ষ লক্ষ মানুষের জন্য আনন্দের সংবাদ। আমরা বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা ধরে রাখতে পেরেছি এবং বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভোক্তা বাজারে প্রবেশের নতুন সুযোগ তৈরি করেছি।”
সূত্র: বিবিসি