গণঅভ্যুত্থানে নিহত হৃদয়ের লাশের খোঁজে এক বছর পর তুরাগে অভিযান
- গাজীপুর প্রতিনিধি
- প্রকাশঃ ০৫:৪২ পিএম, ২৫ জুলাই ২০২৫

গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে গত বছরের গণঅভ্যুত্থানের সময় গুলিতে নিহত শিক্ষার্থী মো. হৃদয়ের মরদেহ উদ্ধারে এক বছর পর নতুন করে তল্লাশি অভিযান চালিয়েছে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত তুরাগ নদীর কড্ডা এলাকায় চলে এ তল্লাশি।
অভিযানে অংশ নেয় গাজীপুর, টঙ্গী ও ঢাকা থেকে আসা ফায়ার সার্ভিসের বিশেষ ডুবুরি দল। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত দলের নেতৃত্বে এই অভিযান পরিচালিত হয়। নিহত হৃদয়ের পরিবার, পুলিশ এবং ট্রাইব্যুনালের কর্মকর্তারাও এসময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। তবে সন্ধান মেলেনি হৃদয়ের লাশের।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গ্রেফতার এক আসামির স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে নদীতে অভিযান চালানো হয়। তদন্তে উঠে এসেছে, নিহত হৃদয়কে হত্যার পর তার মরদেহ তুরাগ নদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছিল।
হৃদয় ছিলেন টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার আলম নগর গ্রামের বাসিন্দা, লাল মিয়ার ছেলে। হেমনগর ডিগ্রি কলেজের একাদশ শ্রেণির এই শিক্ষার্থী পড়ালেখার পাশাপাশি গাজীপুরের কোনাবাড়ী এলাকায় অটোরিকশা চালাতেন। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিখোঁজ হন তিনি। পরিবার এখনও তার মরদেহের খোঁজ পায়নি।
নিহতের চাচাতো ভাই মো. ইব্রাহীম ২০২৪ সালের ২৬ আগস্ট কোনাবাড়ী থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এজাহারে নাম উল্লেখ করা হয় ৫৭ জনের বিরুদ্ধে, এছাড়া অভিযুক্ত হন আরও অনেক অজ্ঞাত পরিচয়ের পুলিশ সদস্য।
মামলার তদন্তে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক দুটি সংস্থা — 'ইন্টারন্যাশনাল ট্রুথ জাস্টিস প্রজেক্ট' এবং 'টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউট' হৃদয়ের ঘটনাটি নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করে। সেখানে হৃদয়কে গুলি করার দৃশ্যও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সেই ভিডিও প্রকাশের পর ঘটনাটি নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়।
এ ঘটনায় পুলিশ সদস্য আকরাম হোসেনসহ আরও একজনকে গ্রেফতার করেছে গোয়েন্দা বিভাগ। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই বৃহস্পতিবার সকাল থেকে তুরাগ নদীতে তল্লাশি অভিযান শুরু হয়।
অভিযানে উপস্থিত ছিলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর এস এম তাসমিরুল ইসলাম, গাজীপুর ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক মোহাম্মদ মামুন, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এবং ট্রাইব্যুনালের পরিদর্শক মাসুদ পারভেজ।
গাজীপুর মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক সাইফুল ইসলাম জানান, এ মামলায় কিশোরগঞ্জের পারাইল এলাকা থেকে পুলিশ কনস্টেবল আকরাম হোসেনসহ মোট ১১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কনস্টেবল আকরাম হোসেন গাজীপুর শিল্প পুলিশে কর্মরত ছিলেন। এছাড়া, হৃদয়ের লাশ নদীতে ফেলার কাজে ব্যবহৃত গাড়ির চালককেও সম্প্রতি আটক করা হয়। তার দেখানো স্থানেই তুরাগ নদীর কড্ডা এলাকায় তল্লাশি চালানো হয়। তবে বৃহস্পতিবারের অভিযানেও কোনো মরদেহ উদ্ধার হয়নি।
গাজীপুর ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক মোহাম্মদ মামুন বলেন, “হৃদয়ের লাশ খুঁজতে সকাল ১০টায় অভিযান শুরু হয়। বিকেল ৩টা পর্যন্ত নদীর ভাটির দিকে প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকায় ডুবুরি দল তল্লাশি চালালেও কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।”
অভিযানের সময় নিহত হৃদয়ের বড় বোন জেসমিন আক্তার বলেন, “আমার ভাইকে পুলিশ গুলি করে মেরেছে। এর ভিডিও সব জায়গায় আছে। অথচ আজও আমার ভাই শহীদের মর্যাদা পায়নি। আমার ভাইয়ের লাশের সন্ধান পেতে আরও দু-এক বছর লাগলেও আমি আশাবাদী। কারণ, আমার ভাইয়ের হাঁড়ও যদি পাই, তা গ্রামের বাড়িতে নিয়ে মাটি দিতে পারলে বাবা-মা শান্তি পাবে। তারা সবসময়ই কান্নাকাটি করেন। ভাইয়ের লাশ আমাদের পারিবারিক গোরস্থানে নিয়ে মাটি দিতে পারলে তাদের কষ্ট কিছুটা হলেও দূর হবে।”
মামলার এজাহারে উল্লেখ রয়েছে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গাজীপুরের কোনাবাড়ী এলাকায় কুদ্দুছ নগর অ্যাঞ্জেল গেট সংলগ্ন সড়কে অবস্থান করছিলেন হৃদয় ও তার মামাতো ভাই ইব্রাহীম। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অংশ হিসেবে ছাত্র-জনতা সেদিন সরকারবিরোধী বিভিন্ন দাবিতে স্লোগান দিচ্ছিল। অভিযোগ অনুসারে, তখন সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমত উল্লা ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলমের নির্দেশে ২৫০ থেকে ৩০০ জনের একটি সশস্ত্র দল আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায়।
পুলিশি গুলির মুখে হৃদয় আশ্রয় নেন একটি দোকানে। কিন্তু অজ্ঞাত পরিচয়ের কয়েকজন পুলিশ সদস্য সেখান থেকে তাকে টেনে রাস্তায় এনে গুলি করে বলে মামলায় দাবি করা হয়। ঘটনার সময় হৃদয়ের স্বজন ও আশপাশের লোকজন সেই দৃশ্য মোবাইলে ভিডিও করেন।
ডুবুরি দল অভিযানে ব্যর্থ হলেও হৃদয়ের পরিবার এখনো আশার আলো হারায়নি। তদন্ত ও তল্লাশি চলমান রয়েছে।