জুলাই সনদের আদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর ভিন্নমত গুরুত্ব পাবে না
- নিউজ ডেস্ক
- প্রকাশঃ ১২:২১ পিএম, ২১ অক্টোবর ২০২৫

জুলাই সনদ বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তাবিত আদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর ‘নোট অব ডিসেন্ট’ বা ভিন্নমতকে গুরুত্ব না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, ভিন্নমতের ভিত্তিতে গণভোট আয়োজন যেমন সম্ভব নয়, তেমনি ভিন্নমত রেখে সংস্কার বাস্তবায়নও কার্যকর নয় বলেই মনে করছে কমিশনের বিশেষজ্ঞ প্যানেল।
রবিবার অনুষ্ঠিত এক বৈঠকের পর সোমবার কমিশনের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের কয়েকজন সদস্য এই মত প্রকাশ করেন। তাঁদের মতে, ভিন্নমত যুক্ত থাকলে প্রস্তাবিত আদেশে জনগণের সম্মতি পাওয়া কঠিন হবে। তারা স্পষ্টভাবে বলেন, “ভিন্নমতসহ গণভোট সম্ভব না। ভিন্নমত রেখে সংস্কার এগিয়ে নেওয়াও অসম্ভব।”
কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানিয়েছেন, আদেশের খসড়া চূড়ান্ত করার কাজ চলমান। তাঁর ভাষায়, “আশা করছি দু-তিন দিনের মধ্যে তা চূড়ান্ত করা সম্ভব হবে।” কমিশন ২৪ অক্টোবরের মধ্যে সরকারকে চূড়ান্ত সুপারিশ দিতে চায় যাতে সরকারের হাতে আদেশ জারির জন্য অন্তত এক সপ্তাহ সময় থাকে।
কমিশনের আগের আলোচনায় সিদ্ধান্ত হয়েছে যে নাগরিকদের মত জানাতে ‘সনদ’-এর ওপর নয়, ‘আদেশ’-এর ওপরই গণভোট হবে। প্রাক-খসড়া অনুযায়ী, ব্যালটে থাকবে প্রশ্ন: “আপনি সরকার ঘোষিত আদেশ সমর্থন করেন কিনা?”
দুই বিশেষজ্ঞ জানান, খসড়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এটি সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নয়, বরং জুলাই মাসের গণঅভ্যুত্থানের ভিত্তিতে প্রস্তুত হচ্ছে। তাঁদের মতে, এই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জনগণের সার্বভৌম কর্তৃত্ব প্রয়োগ হয়েছে, এবং সেই ক্ষমতাবলে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার এই আদেশ জারি করবে।
বিশেষজ্ঞদের ভাষায়, অতীত অভিজ্ঞতা বলছে অন্তর্বর্তী সরকার প্রায়ই সিদ্ধান্ত গ্রহণে দৃঢ়তা দেখাতে ব্যর্থ হয়। তারা সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, যেন জুলাই সনদের আদেশ বাস্তবায়নে রাজনৈতিক চাপ উপেক্ষা করে কঠোর অবস্থান নেয়। তাদের কথায়, “আদেশ জারি ছাড়া গণভোট আয়োজনের আইনি পথ নেই।”
কমিশনের এক সদস্য জানিয়েছেন, “গত জুলাই থেকেই সরকারকে বলা হয়েছে সংস্কারের জন্য শক্ত অবস্থান নিতে।” প্রধান উপদেষ্টা শুরুতে এ বিষয়ে আশ্বাস দিলেও পরে রাজনৈতিক দলগুলোর মতভিন্নতার ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ অবস্থান নেন এবং সংস্কারকে তাদের ঐকমত্যের ওপর ছেড়ে দেন।
কমিশনের সূত্রে জানা গেছে, চূড়ান্ত সুপারিশে সরকারকে শক্ত অবস্থানে যাওয়ার আহ্বান জানানো হবে।
গত ১৭ অক্টোবর রাজনৈতিক দলগুলোর স্বাক্ষরিত সনদে অন্তর্ভুক্ত ছিল ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব, যার মধ্যে ৯টি মৌলিক সংস্কারে বিএনপি ‘নোট অব ডিসেন্ট’ প্রদান করে। দলটি ঘোষণা দিয়েছে, ক্ষমতায় এলে এই সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন করবে না। বিএনপির দাবি ছিল, তারা ভিন্নমত যুক্ত না করলে সনদে স্বাক্ষর করবে না। শেষ পর্যন্ত এই শর্ত যুক্ত করে দেওয়া হয় যে, যেসব সংস্কারে দলগুলোর ভিন্নমত রয়েছে, সেগুলো তারা নিজেদের নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখ করতে পারবে এবং জয়ী হলে পরিবর্তন করতে পারবে।
তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, এই বিধান থাকলে পুরো সংস্কার প্রক্রিয়াই হুমকির মুখে পড়বে। কারণ, ৮৪টি প্রস্তাবিত সংস্কারের মধ্যে সর্বসম্মত মত আছে মাত্র ৮ থেকে ১০টিতে। একটি উদাহরণে দেখা যায়, সংসদের দুই কক্ষে বিরোধী দলের ডেপুটি স্পিকার নিয়োগের প্রস্তাবে বিএনপি, জামায়াত, ইসলামী আন্দোলনসহ ২৯টি দল একমত হলেও বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগের মতো একটি দল ভিন্নমত দিয়েছে।
কমিশনের এক সদস্য মন্তব্য করেন, “যদি সব নোট অব ডিসেন্ট গ্রহণ করা হয়, তাহলে সংস্কার বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না।” তাঁর মতে, গণভোটে কেবল সর্বসম্মত সংস্কার গ্রহণের সিদ্ধান্ত কার্যকর হলেও ভবিষ্যতে তা ব্যাহত হতে পারে। কারণ, ক্ষমতাসীন দল তখন নোট অব ডিসেন্টকে সামনে রেখে সংস্কার থেকে সরে দাঁড়াতে পারে।
এই সংকট এড়াতেই সিদ্ধান্ত হয়েছে, গণভোট অনুষ্ঠিত হবে ‘আদেশ’-এর ওপর, ‘সনদ’-এর ওপর নয়। সেই আদেশ হবে মূল দলিল, যেখানে সনদ একটি সংযুক্ত অংশ হিসেবে থাকবে। জনগণ আদেশে সম্মতি দিলে নতুন সংসদ তার আলোকে সনদের বাস্তবায়ন করবে। আর ‘নোট অব ডিসেন্ট’ গণভোটে স্থান পাবে না; তবে আদেশে উল্লেখ থাকবে, ভবিষ্যতের সংসদ চাইলে সেগুলো কীভাবে সমন্বয় করবে।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার জানিয়েছেন, মঙ্গলবার অথবা বুধবার বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সঙ্গে ফের বৈঠক করবে কমিশন এবং চূড়ান্ত করা হবে আদেশের খসড়া।