জুমার দিন সূরা কাহফ পড়লে কী হয়? জানুন হাদীসের আলোকে অবাক করা ফজিলত
- ইসলাম ডেস্ক
- প্রকাশঃ ১১:১৪ এম, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫

প্রতিটি জুমার দিন মুসলিম উম্মাহর জন্য একটি বিশেষ দিন, যা আল্লাহর রহমত, বরকত এবং মাগফিরাত লাভের সুবর্ণ সুযোগ নিয়ে আসে। ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে জুমার দিনকে সপ্তাহের শ্রেষ্ঠ দিন হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
এই দিনকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে চাইলে কিছু বিশেষ আমলের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। তার মধ্যে অন্যতম হলো সূরা কাহফ তিলাওয়াত।
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর বাণী সূরা কাহফ সম্পর্কে কী বলে?
আবু সাঈদ খুদরি (রাদিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইরশাদ করেন, "যে ব্যক্তি জুমার দিনে সূরা কাহফ তিলাওয়াত করে, আল্লাহ তায়ালা তার জন্য দুই জুমার মাঝখানে একটি নূরের আলো সৃষ্টি করেন, যা তাকে আলোকিত করে রাখে।" - (সহীহুল জামে: ৬৪৭০)
অন্য এক হাদীসে নবী করিম (সা.) বলেন, "যে ব্যক্তি সূরা কাহফের প্রথম দশ আয়াত মুখস্থ রাখবে, সে দাজ্জালের ফিতনা থেকে রক্ষা পাবে।" - (সহীহ মুসলিম)
এই হাদীস দুটি থেকে পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়, সূরা কাহফ শুধুমাত্র একটি তিলাওয়াতযোগ্য সূরা নয়, বরং এটি একজন মুমিনের ঈমান ও আত্মাকে ফিতনা থেকে রক্ষা করার এক বিশেষ উপায়।
সূরা কাহফের শিক্ষণীয় বার্তা
সূরা কাহফ শুধু একটি তিলাওয়াতযোগ্য সূরা নয়, বরং এটি মানব জীবনের গুরুত্বপূর্ণ চারটি ফিতনা বা পরীক্ষার চিত্র তুলে ধরে এবং সে ফিতনাগুলোর থেকে বাঁচার পথনির্দেশও দেয়। এই সূরাটির বিভিন্ন কাহিনী আমাদের ব্যক্তিজীবন, সমাজজীবন এবং চিন্তাধারায় গভীর প্রভাব ফেলতে পারে।
প্রথম কাহিনীটি আশহাবে কাহফের, যারা তরুণ বয়সেই আল্লাহর প্রতি অটুট বিশ্বাস নিয়ে নিজেদের ঈমান রক্ষা করতে একাধিপত্যশালী শাসকের বিরুদ্ধে গুহায় আশ্রয় নেয়। তারা সংখ্যায় অল্প হলেও ঈমানের দিক থেকে তারা ছিল অদ্বিতীয়। এই কাহিনী থেকে বোঝা যায়, ঈমান রক্ষা করতে হলে কখনো কখনো সমাজের বিরুদ্ধেও দাঁড়াতে হয়, এবং সে সাহস মূলত আসে আল্লাহর ওপর পূর্ণ ভরসা থেকে।
পরবর্তী কাহিনীতে দুই বাগানের মালিকের গল্প বর্ণিত হয়েছে। এখানে আমরা দেখি, এক ব্যক্তি তার ধন-সম্পদ, কৃষি ও সামাজিক অবস্থান দেখে এতটাই গর্বিত হয়ে পড়ে যে সে আল্লাহর অস্তিত্ব ও পরকালের বিচার সম্পর্কেই সন্দেহ করতে থাকে। কিন্তু হঠাৎ একটি বিপর্যয়ে তার সবকিছু ধ্বংস হয়ে যায়। এই ঘটনাটি মানুষের দুনিয়াবি মোহ, অহংকার ও সম্পদের ক্ষণস্থায়ীত্ব সম্পর্কে গভীর শিক্ষা দেয়। এর মাধ্যমে কুরআন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, যে সম্পদ মানুষকে আল্লাহ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়, সেটি ধ্বংসশীল ও বিপজ্জনক।
তৃতীয় কাহিনীটি নবী মূসা (আ.) ও খিজির (আ.)-এর মধ্যকার একটি জ্ঞানভিত্তিক সফরের। এখানে নবী মূসা (আ.) এমন কিছু কাজ প্রত্যক্ষ করেন যা বাহ্যিকভাবে অন্যায় বা অনুচিত মনে হলেও পরে তা একেকটি গভীর হিকমতপূর্ণ ঘটনায় পরিণত হয়। এই অংশটি মানুষকে শিক্ষা দেয় যে, আল্লাহর পরিকল্পনার গভীরতা আমরা সবসময় বুঝে উঠতে পারি না। জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা মেনে নেওয়া এবং ধৈর্য ও নম্রতা বজায় রাখা একজন ঈমানদারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সবশেষে আসে যুলকারনাইনের কাহিনী। তিনি ছিলেন একজন ন্যায়পরায়ণ ও বিচক্ষণ শাসক, যিনি আল্লাহর দিকনির্দেশনা অনুযায়ী দূরদূরান্তে ভ্রমণ করে বিভিন্ন জাতির সমস্যার সমাধান করেছেন। তিনি দুর্বল ও নিপীড়িত জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করেছেন এবং ইয়াজুজ-মাজুজের মত অশান্তির উৎসগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন। এই কাহিনী নেতৃত্ব, ন্যায়বিচার ও আল্লাহর সন্তুষ্টিকে প্রাধান্য দিয়ে সমাজ গঠনের একটি মডেল উপস্থাপন করে।
এই চারটি কাহিনীর মধ্য দিয়ে সূরা কাহফ আমাদের শেখায় ঈমান, ধনসম্পদ, জ্ঞান এবং ক্ষমতার ক্ষেত্রে কিভাবে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখতে হয় এবং কিভাবে এসব বিষয়ে পরীক্ষার সম্মুখীন হলে একজন মুমিনকে আচরণ করতে হয়। একই সঙ্গে এটি জীবনের নানা পর্যায়ে আল্লাহর ওপর নির্ভরতা, ধৈর্য, বিনয় ও আত্মনিয়ন্ত্রণের চর্চা করতে উদ্বুদ্ধ করে। তাই সূরা কাহফ কেবল একটি সূরা নয়, বরং এটি একটি জীবন্ত শিক্ষা; যা আমাদের আধুনিক সময়ের ফিতনা মোকাবেলায় প্রস্তুত করে।
কখন পড়বেন সূরা কাহফ?
উলামায়ে কেরাম বলেন, সূরা কাহফ তিলাওয়াতের ফজিলত পেতে হলে এটি বৃহস্পতিবার সূর্যাস্ত থেকে শুরু করে শুক্রবার সূর্যাস্তের মধ্যে যেকোনো সময় তিলাওয়াত করা যেতে পারে। কেউ যদি আরবি উচ্চারণে পারদর্শী না হন, তাহলে তিনি অর্থসহ পড়ে এর শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন। কেউ চাইলে নির্ভুল উচ্চারণ রপ্ত করে মুখস্থ করতেও পারেন।
বর্তমান প্রজন্মের বাস্তবতা ও সূরা কাহফের প্রাসঙ্গিকতা
বর্তমান সময়ে ফিতনা বেড়ে গেছে বহুগুণে। দাজ্জালের ফিতনা তো এক চরম বাস্তবতা, পাশাপাশি রয়েছে নাস্তিকতা, অপসংস্কৃতি, মিডিয়া বিভ্রান্তি এবং বিশ্বাসবিনাশী নানা চিন্তাধারার ছড়াছড়ি। এই প্রেক্ষাপটে তরুণ প্রজন্মের ঈমান রক্ষা করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। আলেম সমাজের মতে, সূরা কাহফ এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য একটি শক্তিশালী আত্মরক্ষামূলক ঢাল। এটি একদিকে যেমন ফিতনা থেকে রক্ষা করে, অন্যদিকে আল্লাহর প্রতি তাওয়াক্কুল, ধৈর্য ও আত্মবিশ্বাসও বাড়ায়।
তাই তরুণদের প্রতি উদাত্ত আহ্বান, তারা যেন জুমার দিন সূরা কাহফ পড়া এবং বোঝার প্রতি মনোযোগী হয়। এই নিয়মিত আমল শুধু দুনিয়ায় নয়, আখিরাতে নাজাতের পথ খুলে দিতে পারে।