বাংলাদেশি পরিচয়ে ভারতীয় পরিবারকে পুশ ইন, ভিডিওতে আবেগঘন মুহূর্ত
- আন্তর্জাতিক ডেস্ক
- প্রকাশঃ ০৬:৪৭ পিএম, ২৫ জুলাই ২০২৫

দিল্লিতে দিনমজুরের কাজ করা দুটি পরিবারকে বাংলাদেশি পরিচয়ে বাংলাদেশে পুশ ইন করেছে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। যদিও পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ এবং স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা জোর দিয়ে বলছেন, এই পরিবারগুলোর অন্তত একটি প্রকৃতপক্ষে ভারতের নাগরিক এবং তাদের বসবাস বিখ্যাত বীরভূম জেলার অন্তর্গত।
মুরারই থানার ওসি জানিয়েছেন, তিনি সরকারি দপ্তর থেকে অন্তত ১০টি গুরুত্বপূর্ণ নথি সংগ্রহ করেছেন, যা এই পরিবারের ভারতীয় পরিচয় প্রমাণ করে। অপর একটি পরিবারকেও বীরভূমের পাইকর থানার এলাকার বাসিন্দা বলা হচ্ছে, যদিও তাদের কাগজপত্র যাচাই এখনো চলমান।
এদিকে দিল্লি পুলিশ দাবি করেছে, ওই ছয়জন ব্যক্তি বাংলাদেশের বাগেরহাট জেলার মোলারগাং ছেপুয়ার পাড় গ্রামের বাসিন্দা।
তবে পশ্চিমবঙ্গ পরিযায়ী শ্রমিক কল্যাণ পর্ষদের চেয়ারম্যান এবং তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ সামিরুল ইসলাম জানিয়েছেন, 'যেগুলো বাংলাদেশি হিসেবে দেখানো হয়েছে', তাদের পরিবারের পূর্বপুরুষদের নামে ১৯৫০, ৬০ ও ৭০-এর দশকের জমির দলিলসহ নানা নথিপত্র পাওয়া গেছে।
এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কলকাতা হাইকোর্ট ও দিল্লি হাইকোর্টে মামলা দায়ের করেছে পরিবারগুলোর আত্মীয়স্বজন।
সামিরুল ইসলাম তার এক্স (পূর্বতন টুইটার) হ্যান্ডেলে পোস্ট করা একটি ভিডিওতে জানিয়েছেন, পরিবারের সদস্যরা নিজেদের ভারতীয় বলেও দাবি করেছেন এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে তাঁদের ‘নিজ দেশে’ ফিরিয়ে আনার আর্জি জানিয়েছেন।
তবে বর্তমানে বাংলাদেশে এই পরিবারগুলোর অবস্থান কোথায়, তা স্পষ্ট নয়।
ধরে নিয়ে যাওয়া, তারপর বাংলাদেশে পাঠানো
মুরারই থানার ধিতোরা গ্রামের আর্জিলা বিবি অভিযোগ করেছেন, তার পুত্রবধূ সুইটি বিবি ও দুই নাতি — কুরবান শেখ (১৬) ও ইমাম শেখ (৬) নিখোঁজ।
পরিযায়ী শ্রমিক ঐক্য মঞ্চের আহ্বায়ক আসিফ ফারুক জানিয়েছেন, দিল্লির রোহিনী এলাকায় কাজ করতে গিয়েছিলেন সুইটি ও তার দুই সন্তান। সেখানে কেএন কাটজু মার্গ থানার পুলিশ তাদের আটক করে বাংলাদেশি সন্দেহে। এরপর তাদের এফআরআরও-র (Foreigners Regional Registration Office) কাছে হস্তান্তর করা হয়।
একইভাবে পাইকর থানা এলাকার বাসিন্দা বলে পরিচিত সোনালি খাতুন, তার স্বামী দানেশ শেখ এবং পুত্র সাবির শেখকেও একই থানায় আটক করে। পরবর্তীতে তাদেরও এফআরআরও বাংলাদেশি ঘোষণা করে।
ওই দপ্তরের নির্দেশনামায় লেখা হয়েছে, এই ছয়জনের বাড়ি বাংলাদেশের বাগেরহাট জেলায়।
পরিবারের কাহিনি: অভিযোগ আর কান্না
সোনালি খাতুনের ফুফাতো বোন রোশনি খাতুন জানান, তারা বীরভূম জেলার বাসিন্দা এবং বর্তমানে দিল্লির রোহিনী ২৬ নম্বর সেক্টরের বাঙালি বস্তিতে থাকেন। তার কথায়, 'গত মাসে সোনালি, ওর স্বামী আর বাচ্চা ছেলেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। সোনালি তখন চার মাসের গর্ভবতী ছিল। অনেক কান্নাকাটি করেও কিছু হয়নি। আমরা বলেছিলাম, ওদের কাগজপত্র পরীক্ষা করুন। কেউ শুনেনি।'
তিনি আরও জানান, সোনালির বড় মেয়েটি এখন তার নানির কাছে রয়েছে এবং 'ওরা দু'বার ফোন করেছিল বাংলাদেশ থেকে, খুব কাঁদছিল... কিছু বলতে পারছিল না, কোথায় আছে তাও বোঝাতে পারল না।'
আসিফ ফারুকের ভাষ্যমতে, গত মাসে দিল্লির বস্তি থেকে এই দুই পরিবারকে তুলে বিমানে আগরতলায় পাঠানো হয়। সেখান থেকে ত্রিপুরার কোনো সীমান্ত দিয়ে বিএসএফ তাদের বাংলাদেশে পুশ ইন করে।
নাগরিকত্বের প্রমাণ হিসেবে যা যা মিলেছে
মুরারই থানার পুলিশ যেসব নথি সংগ্রহ করেছে, তার মধ্যে রয়েছে আধার কার্ড, ইমাম শেখের সরকারি হাসপাতালে জন্মের সনদ, স্থানীয় পঞ্চায়েত প্রধানের সুপারিশপত্র, ব্লক উন্নয়ন আধিকারিকের সার্টিফিকেট প্রভৃতি।
এছাড়াও ১৯৬৬ সালের একটি জমির দলিল পাওয়া গেছে, যা সুইটি বিবির দাদু বাবু শেখের নামে রেজিস্ট্রি করা হয়েছিল। এমনকি ঝাড়খণ্ডের পাকুর জেলার স্থানীয় পঞ্চায়েতের দেওয়া একটি বংশ তালিকাও সংগ্রহ করেছে পুলিশ, যেখানে সুইটির পূর্বপুরুষদের নাম রয়েছে।
সামিরুল ইসলাম বুধবার এক্স হ্যান্ডেলে সুইটি বিবির দুই দাদু — জামিরুদ্দিন খান ও বাবু শেখ এবং সোনালির দাদুর বাবা মনখুস শেখের নামে থাকা জমির দলিলের ছবি প্রকাশ করেন। এসব দলিল ৫০, ৬০ ও ৭০-এর দশকের।
সেখানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে ট্যাগ করে সামিরুল লেখেন, “দয়া করে একটি সংসদীয় কমিটি গঠন করুন, মাঠ পর্যায়ে যাচাই করে দেখুন এরা বাংলাদেশের নয়, ভারতেরই নাগরিক।”
ভিডিওতে আত্মবর্ণনা: কান্না, অনুরোধ ও অভিযোগ
বাংলাদেশে প্রত্যর্পণ হওয়া পরিবারের এক ভিডিও এসেছে প্রকাশ্যে, যেখানে দেখা যায় দুই নারী, দুটি শিশু, এক কিশোর ও এক পুরুষ। ধারণা করা হচ্ছে, ভিডিওটি বাংলাদেশেই ধারণ করা হলেও নির্দিষ্ট জায়গা এখনো অজানা।
ভিডিওটি সামিরুল ইসলাম তার এক্স হ্যান্ডেলে পোস্ট করেছেন। ভিডিওতে এক নারী দিল্লি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তারের বিবরণ দিচ্ছেন। আসিফ ফারুক দাবি করেন, তিনি সুইটি বিবি।
ভিডিওতে সুইটি বিবি বলেন, 'আমাদের দিল্লি থেকে ধরেছে... আমরা কাজ করতে গিয়েছিলাম। আধার কার্ড দেখালাম, আমরা বাংলাদেশি নই।' তিনি আরও বলেন, 'তাও জবরদস্তি ওরা কি কি লিখিয়ে নিলে তোদেরকে বাংলাদেশি বানিয়ে দেব।'
তার অভিযোগ, প্রথমে থানায়, পরে একটি বাড়িতে চার দিন আটকে রাখা হয়, যেখানে ছবি, আঙুলের ছাপ, এমনকি হাসপাতালেও নিয়ে যাওয়া হয় শারীরিক পরীক্ষার জন্য। তিনি জানান, বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার পর তারা এখন কার্যত নিরাশ্রয়, শুধুমাত্র একটি কাপড় পরে অন্যের বারান্দায় রাত কাটাচ্ছেন, মশার কামড়ে অতিষ্ঠ। শেষে তার আবেগঘন আর্তি —'অনুরোধ করছি আমাদের এখান থেকে নিয়ে যান মমতা দিদি।'
সূত্র: বিবিসি বাংলা