ইসরায়েলি আগ্রাসনে নিরুপায় মায়ের চোখের সামনেই মরছে ক্ষুধার্ত শিশু


ইসরায়েলি আগ্রাসনে নিরুপায় মায়ের চোখের সামনেই মরছে ক্ষুধার্ত শিশু

গাজায় মানবিক বিপর্যয় চরমে পৌঁছেছে। মায়ের চোখের সামনে ক্ষুধার যন্ত্রণায় মারা যাচ্ছে শিশু, আর চিকিৎসকরা প্রতিটি ঘণ্টায় পাচ্ছেন অপুষ্টিতে আক্রান্ত রোগী। গাজার কেন্দ্রীয় হাসপাতালগুলো এখন মৃত্যুর মিছিলের চিত্র তুলে ধরছে।

গত কয়েক দিনে দুটি হৃদয়বিদারক ঘটনার খবর পাওয়া গেছে। গাজা শহরের একটি ৩৫ দিনের শিশু এবং দেইর আল-বালাহ এলাকার চার মাস বয়সী আরেক শিশু মারা গেছে মারাত্মক অপুষ্টিতে। আল-আকসা শহীদ হাসপাতালে সন্তানকে হারানো এক মা কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, “আমি দুঃখিত, আমি তোমাকে খাওয়াতে পারিনি। আমার চোখের সামনে তোমাকে মরতে দেখা ছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিল না।”

এমন করুণ দৃশ্য এখন গাজার অভ্যন্তরে নিয়মিত ঘটনা। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, প্রতিটি ঘণ্টায় অপুষ্টিতে ভোগা শিশু আসছে চিকিৎসার জন্য। কিন্তু পর্যাপ্ত খাদ্য ও ওষুধ না থাকায় চিকিৎসা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

ক্ষুধার সঙ্গে লড়াই করতে গাজাবাসীরা বাধ্য হয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সহযোগিতায় পরিচালিত জিএইচএফ (GHF) বিতরণ কেন্দ্রে ভিড় করছেন। অনেক বাবা-মা জানিয়েছেন, তারা নিজেরা এবং তাদের শিশুরা কয়েকদিন ধরে অনাহারে। অনেক শিশু শুধু পানি খেয়ে বেঁচে আছে, কারণ অনেক পরিবার চাহিদা অনুযায়ী খাবার বা আটা কিনতে পারছে না।

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, গত ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ১৩০ জন নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ৫৪ জন ছিলেন ত্রাণের জন্য অপেক্ষমাণ। আহত হয়েছেন আরও ৪৯৫ জন। পুরো যুদ্ধে এখন পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৮ হাজার ৮৯৫ জন এবং আহত হয়েছেন ১ লাখ ৪০ হাজার ৯৮০ জন।

আলজাজিরার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ইসরায়েলি বাহিনীর মধ্যে চরম মানসিক চাপ বিরাজ করছে। দক্ষিণ ইসরায়েলের এক প্রশিক্ষণ ঘাঁটিতে আত্মহত্যা করেছেন নরওয়ের বাসিন্দা ও প্রশিক্ষণরত সৈনিক ড্যান ফিলিপসন। দুই সপ্তাহে এ নিয়ে চারজন ইসরায়েলি সেনার আত্মহত্যার ঘটনা ঘটল। দেশটির গণমাধ্যম জানিয়েছে, ২০২৫ সালের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ১৯ জন এবং যুদ্ধের ২১ মাসে মোট ৪২ জন সেনা আত্মহত্যা করেছেন।

গাজায় ইসরায়েলি হামলার নিন্দা জানিয়েছেন পোপ লিও। গত বৃহস্পতিবার গাজার একমাত্র ক্যাথলিক গির্জায় হামলার পর রোববার এক প্রার্থনা সভায় তিনি যুদ্ধের অবসানের আহ্বান জানান।

ইসরায়েলি বিশ্লেষক গিডিয়ন লেভি সরকারের বিরুদ্ধে গাজায় জাতিগত নিধনের পরিকল্পনার অভিযোগ তুলেছেন। এদিকে ইসরায়েলি সেনারা গাজার মধ্যাঞ্চল থেকে লোকজনকে সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে।

যুক্তরাজ্যে নিষিদ্ধঘোষিত মানবাধিকার সংগঠন 'প্যালেস্টাইন অ্যাকশন গ্রুপ'-এর ৫৫ জন সদস্যকে আটক করা হয়েছে বলে জানা গেছে।

তুরস্কের আনাদোলু এজেন্সি গাজার পরিস্থিতিকে কারবালার সঙ্গে তুলনা করেছে। তারা জানায়, যেমন ইমাম হুসাইনের শিবিরকে অবরুদ্ধ করে পানির পথ বন্ধ করে দিয়েছিল এজিদের বাহিনী, তেমনি আজ ইসরায়েল গাজার পানি সরবরাহ ধ্বংস করে দিয়েছে। এই অবরোধের মধ্যে, একসঙ্গে প্রাণ হারিয়েছে দুই শিশু—৯ বছরের কারাম আল-ঘুসাইন এবং ১০ বছরের লানা ওরফে লুলু। পানি আনার উদ্দেশ্যে ছোট একটি পাত্র হাতে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল কারাম। ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র তার দেহ ছিন্নভিন্ন করে দেয়। ছোট ভাইকে সাহায্য করতে ছুটে আসা লানা একই পরিণতি বরণ করে।

জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী সংস্থা (UNRWA) সতর্ক করেছে, গাজায় ইসরায়েল একটি ‘নীতি-ভিত্তিক ক্ষুধার্ত রাখা’র কৌশল অবলম্বন করছে। এতে করে ১০ লাখ শিশু সরাসরি খাদ্য সংকটের মুখে রয়েছে।

জিএইচএফ মাত্র চারটি পয়েন্ট থেকে খাদ্য সরবরাহ করছে। সেই জায়গাগুলিতে ত্রাণ নিতে আসা মানুষের ওপর প্রতিদিন গুলি চালাচ্ছে দখলদার বাহিনী। মে মাসের শেষ থেকে এই কেন্দ্রে ত্রাণ নিতে এসে প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় ৯০০ মানুষ।

গাজা যেন আজ এক অদৃশ্য বধ্যভূমি। শিশুদের ক্ষুধা মেটাতে না পেরে মায়েরা কাঁদছেন, কিন্তু তাঁদের আর কিছু করার নেই। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নীরবতা পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করে তুলছে। যুদ্ধ নয়, এখন গাজার মানুষ চায় এক ফোঁটা পানি, এক মুঠো খাবার আর বেঁচে থাকার ন্যূনতম সুযোগ।

ঢাকাওয়াচ২৪ডটকমে লিখতে পারেন আপনিও ফিচার, তথ্যপ্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, ভ্রমণ ও কৃষি বিষয়ে। আপনার তোলা ছবিও পাঠাতে পারেন [email protected] ঠিকানায়।
×