গাজায় ইসরাইল পরিকল্পিতভাবে হাজার হাজার ভবন ধ্বংস করছে


গাজায় ইসরাইল পরিকল্পিতভাবে হাজার হাজার ভবন ধ্বংস করছে

ইসরায়েলি সেনাবাহিনী গাজার বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাপকভাবে ভবন ধ্বংসের কাজ অব্যাহত রেখেছে, যা পরিকল্পিতভাবে পরিচালিত হচ্ছে বলে জানা গেছে। মার্চে হামাসের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি শেষের পর থেকে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে হাজার হাজার ভবন সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গেছে, যেখানে আগে বিপুলসংখ্যক মানুষ বসবাস করতেন।

স্যাটেলাইট ছবিতে দেখা যায়, যেসব এলাকা ইসরায়েলি বাহিনী ‘অপারেশনাল নিয়ন্ত্রণে’ নিয়েছে, সেগুলোতে ব্যাপক ধ্বংসের চিত্র স্পষ্ট। শুধু ক্ষতিগ্রস্ত ভবনই নয়, অনেক ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অক্ষত ভবনগুলোকেও মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। যাচাই করা ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, টাওয়ার ব্লক, স্কুল এবং অন্যান্য স্থাপনার ওপর ইসরায়েলি বাহিনীর নিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণে ধুলো ও ধ্বংসাবশেষের বড় মেঘ ছড়িয়ে পড়ছে।

বিবিসি ভেরিফাইয়ের সঙ্গে কথা বলা একাধিক আইন বিশেষজ্ঞের মতে, ইসরায়েলের এই পদক্ষেপ সম্ভবত জেনেভা কনভেনশনের লঙ্ঘন, কারণ দখলদার শক্তির পক্ষ থেকে অবকাঠামো ধ্বংস করা আন্তর্জাতিক মানবিক আইনে নিষিদ্ধ।

আইডিএফ-এর মুখপাত্র দাবি করেছেন, তারা আন্তর্জাতিক আইনের সীমার মধ্যে থেকেই কাজ করছে। তিনি বলেন, “হামাস বেসামরিক এলাকায় সামরিক সরঞ্জাম লুকিয়ে রেখেছে এবং ‘শুধুমাত্র সামরিক প্রয়োজনেই সম্পদ ধ্বংস করা হয়।’”

গাজার রাফা এলাকা সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একাডেমিক কোরি শের এবং জ্যামন ভ্যান ডেন হোকের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এপ্রিল থেকে এখানে নিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণ, এক্সক্যাভেটর ও বুলডোজার ব্যবহারে বিশাল ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে।

ইসরায়েল দাবি করছে গাজার অধিকাংশ এলাকা এখন তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এবং অনেক স্থানে সামরিক জোন বা খালি করার নির্দেশনা কার্যকর রয়েছে। মার্চের পর থেকে বিবিসি ভেরিফাই ৪০টিরও বেশি স্থানে অবকাঠামো ধ্বংসের ভিডিও সংগ্রহ করেছে।

স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা যায়, ধ্বংসের শুরুতে কিছু ভবন অক্ষত ছিল, কিন্তু জুলাইয়ের মধ্যে তারা সম্পূর্ণ মাটির সাথে মিশিয়ে ফেলা হয়েছে। গাজার সৌদি পাড়াতেও এখন ধ্বংসের কাজ চলছে, যেখানে আগে বড় মসজিদ ও কয়েকটি স্কুল ছিল।

রাফার একটি ভিডিওতে দেখা যায়, একটি ট্যাংক চলমান অবস্থায় এবং পাশেই ভেকু কাজ করছে।

গাজার আরও অনেক অংশে, যেখানে আগের বোমাবর্ষণে তেমন ক্ষতি হয়নি, সেখানে সম্প্রতি ব্যাপক ধ্বংসের তথ্য পাওয়া গেছে।

কৃষিভিত্তিক জনপদ খুজাহ ইসরায়েল সীমান্ত থেকে মাত্র ১.৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। যুদ্ধের আগে এই এলাকার জনসংখ্যা ছিল প্রায় ১১,০০০, এবং এটি টমেটো, গম ও জলপাই উৎপাদনের জন্য পরিচিত ছিল। মে মাসের স্যাটেলাইট ছবিতে দেখা যায়, তখনও অনেক ভবন অক্ষত ছিল, তবে জুনের মাঝামাঝি সময়ে এখানকার অধিকাংশ এলাকা ধ্বংস হয়েছে। আইডিএফ দাবি করেছে, খুজাহয়ে তারা ১,২০০টি ভবন গুঁড়িয়ে দিয়েছে, যেগুলো ‘হামাস পরিচালিত সন্ত্রাসী অবকাঠামো’ ছিল।

পার্শ্ববর্তী শহর আবাসান আল-কাবিরায়ও একই ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছে। ৩১ মে থেকে ৮ জুলাই পর্যন্ত মাত্র ৩৮ দিনে ব্যাপক এলাকা মাটি মিশে গেছে।

ইসরায়েল গাজার বিভিন্ন অংশকে আলাদা করে বড় ধরনের ‘নিরাপত্তা অঞ্চল’ এবং করিডর তৈরি করেছে, যেখানে করিডরের আশেপাশের অনেক ভবন ধ্বংস হয়েছে। সর্বশেষ করিডরটি খান ইউনিসের পশ্চিম এবং পূর্ব অংশকে বিভক্ত করেছে, যেখানে খুজাহ ও আবাসান আল-কাবিরাও অন্তর্ভুক্ত।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরায়েল সীমান্তবর্তী এলাকায় ধ্বংস করে ‘বাফার জোন’ তৈরির চেষ্টা করছে। কিন্তু সাম্প্রতিক ধ্বংসযজ্ঞ অনেক দূরের এলাকাতেও বিস্তার লাভ করেছে।

গাজায় প্রায় ৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত কৃষিভিত্তিক বসতি কিজান আবু রাশওয়ানেও অনেক স্থাপনা ধ্বংস হয়েছে। একটি যাচাই করা ভিডিওতে দেখা গেছে, নিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণে বহু বহুতল ভবন ধ্বংস করা হয়েছে।

বিবিসি ভেরিফাই আইডিএফ-এর কাছে ধ্বংসের স্থানসমূহের তালিকা এবং সুনির্দিষ্ট সামরিক কারণ জানতে চেয়েছিল, কিন্তু কোনও উত্তর পাননি।

আইডিএফ মুখপাত্র বলেন, “হামাস এবং অন্যান্য সন্ত্রাসী সংগঠন বেসামরিক এলাকায় সামরিক সরঞ্জাম লুকায়,” এবং তারা সেই অবকাঠামো শনাক্ত করে ধ্বংস করছে।

তবে অনেক মানবাধিকার আইনজীবী বিবিসির সঙ্গে আলাপে বলছেন, এই অভিযান আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের লঙ্ঘন বা যুদ্ধাপরাধের পর্যায়ে পড়তে পারে।

জেরুজালেম ভিত্তিক ডায়াকোনিয়া ইন্টারন্যাশনাল হিউম্যানিটারিয়ান ল’ সেন্টারের সিনিয়র আইন বিশেষজ্ঞ ইতান ডায়মন্ড বলেন, “আন্তর্জাতিক মানবিক আইন যুদ্ধকালে বেসামরিক সম্পদ ধ্বংসকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে, শুধুমাত্র সামরিক প্রয়োজনীয়তার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ।” ভবিষ্যতে সম্ভাব্য হুমকির ভিত্তিতে সম্পত্তি ধ্বংস করা আইনগতভাবে সঠিক নয়।

অক্সফোর্ড ইনস্টিটিউট ফর এথিকস, ল’ অ্যান্ড আর্মড কনফ্লিক্টের সহ-পরিচালক অধ্যাপক জানিনা ডিল বলেন, “দখলদার শক্তির কর্তব্য হলো মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত করা, কিন্তু ধ্বংসযজ্ঞের মাধ্যমে এলাকার বাসযোগ্যতা নষ্ট করা সামরিক নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।”

তবে কিছু বিশ্লেষক আইডিএফ-এর এই অভিযানকে সমর্থন দিয়েছেন।

ঢাকাওয়াচ২৪ডটকমে লিখতে পারেন আপনিও ফিচার, তথ্যপ্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, ভ্রমণ ও কৃষি বিষয়ে। আপনার তোলা ছবিও পাঠাতে পারেন [email protected] ঠিকানায়।
×