২০২৩ সালের অক্টোবরে যুদ্ধ শুরুর পর প্রথমবার পরীক্ষায় বসল গাজার শিক্ষার্থীরা
- আন্তর্জাতিক ডেস্ক
- প্রকাশঃ ০৬:২৮ পিএম, ১৯ জুলাই ২০২৫

যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজা উপত্যকায় শত বাধা উপেক্ষা করে, শিক্ষার্থীরা প্রথমবারের মতো মাধ্যমিকের চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে—তাও অনলাইনে। শনিবার শুরু হওয়া এই পরীক্ষা শুধু শিক্ষাজীবনের একটি ধাপ নয়, বরং যুদ্ধের ছায়া পেরিয়ে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাওয়ার এক সাহসী পদক্ষেপ।
গাজার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে আয়োজিত এই পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে প্রায় দেড় হাজার শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পূর্বশর্ত হিসেবে এই মাধ্যমিক সমাপ্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে সম্পূর্ণ ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে। এটি চলমান যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর শিক্ষার্থীদের জন্য প্রথম কোনো বড় ধরনের পরীক্ষা।
২০২৩ সালের অক্টোবরে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে ভয়াবহ যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর গাজার শিক্ষাব্যবস্থা কার্যত ভেঙে পড়ে। এবার সেই পরিস্থিতির মধ্যেই শিক্ষার্থীরা একটি নতুন অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে পরীক্ষা দিতে পারছে—কেউ নিজ বাড়ি থেকে, কেউবা নির্ধারিত কেন্দ্রে।
পরীক্ষার প্রযুক্তিগত অংশ পরিচালিত হচ্ছে একটি বিশেষ সফটওয়্যারের মাধ্যমে, যাতে কোনো বাধা ছাড়াই শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা সম্পন্ন করতে পারে। মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, পরীক্ষার জন্য সমস্ত প্রযুক্তিগত প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে।
আলজাজিরার প্রতিবেদনে দেইর এল-বালাহ থেকে সাংবাদিক তারেক আবু আজ্জুম জানান, এই পরীক্ষা কেবল উচ্চশিক্ষার সুযোগ নয়, বরং একটি নতুন ভবিষ্যতের সেতুবন্ধ হিসেবেও দেখছেন শিক্ষার্থীরা। তার ভাষায়, “যেখানে নেই পাঠশালা, নেই বই, নেই ইন্টারনেট—তবুও গাজার শিক্ষার্থীরা অনলাইনে সংযুক্ত হচ্ছে, পরীক্ষা দিচ্ছে, যুদ্ধকে তাদের স্বপ্ন থামাতে দিচ্ছে না।”
শিক্ষার পথে এই পদক্ষেপ সহজ ছিল না। দুর্বল ইন্টারনেট, ডিভাইসের সংকট এবং নিরাপদ পরীক্ষাকেন্দ্রের অভাব ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। শিক্ষার্থী দোহা খাত্তাব আলজাজিরাকে বলেন, “অনলাইনে পরীক্ষা দেওয়া খুবই কঠিন। আমাদের অনেকের ডিভাইস নেই, ভালো ইন্টারনেট নেই, নিরাপদ জায়গা নেই। এমনকি বইগুলোও হারিয়ে গেছে বোমার আঘাতে।”
পরীক্ষার আগে শিক্ষার্থীদের জন্য একটি প্র্যাকটিস পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এটি কেবল প্রস্তুতি যাচাই নয়, প্রযুক্তিগত ব্যবস্থা ঠিকঠাক আছে কি না, তাও নিশ্চিত করেছিল।
প্রশ্নোত্তরের জন্য কেউ কেউ ক্যাফে, তাঁবু বা আশ্রয়কেন্দ্র থেকে সংযুক্ত হচ্ছেন, যেখানে বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট পাওয়া যাচ্ছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন কেন্দ্রীয় গাজা গভর্নরেটের পরীক্ষা পরিচালক মোরাদ আল-আঘা জানান, “শিক্ষার্থীরা একটি অ্যাপ ডাউনলোড করে পরীক্ষা দিচ্ছে, তবে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। আমরা এসব সমস্যা মন্ত্রণালয়ের কাছে তুলে ধরেছি সমাধানের জন্য।”
এমন পরিস্থিতিতে কিছু শিক্ষক ক্ষতিগ্রস্ত শ্রেণিকক্ষ আংশিক চালু করে সরাসরি গাইড করছেন শিক্ষার্থীদের। শিক্ষক ইনাম আবু স্লিসা বলেন, “অনলাইন পরীক্ষা নতুন হওয়ায় শিক্ষার্থীরা অনেকটাই বিভ্রান্ত। তাই আমরা ধাপে ধাপে সহায়তা করছি।”
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, চলমান সংঘাতে গাজার ৯৫ শতাংশ শিক্ষা অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে গেছে। প্রায় ৬ লাখ ৬০ হাজার শিশু স্কুলে যেতে পারছে না, যা গাজায় স্কুলগামী শিশুদের মোট সংখ্যার কাছাকাছি। অনেক জাতিসংঘ পরিচালিত স্কুল এখন বাস্তুচ্যুত মানুষের আশ্রয়কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে, যেগুলোও ইসরায়েলি হামলার লক্ষ্যবস্তু।
জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ইসরায়েলি বাহিনী পরিকল্পিতভাবে গাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করেছে। এই পদক্ষেপকে একটি সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
শিক্ষার্থীদের এই পরীক্ষায় অংশ নেওয়া কেবল শিক্ষার ধারাবাহিকতা রক্ষা নয়—এটি একটি প্রতিরোধের প্রতীক। গাজার ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেভাবে ধ্বংসের মধ্যেও স্বপ্ন আঁকড়ে ধরেছে, সেটাই এই মুহূর্তের সবচেয়ে বড় বার্তা।