বাংলাদেশে গতিহারা শেয়ারবাজারে দিশেহারা বিনিয়োগকারী
- নিউজ ডেস্ক
- প্রকাশঃ ০৫:০০ পিএম, ১২ জুন ২০২৫

দেশের শেয়ারবাজারে জালিয়াতি, কারসাজি, দুর্নীতি ও দরপতনে পুঁজি হারিয়ে দিশেহারা বিনিয়োগকারীরা। শুধু সাম্প্রতিক সময়ে নয়, গত ১৫ বছর ধরে চলতে থাকা এসব অনিয়মের প্রভাবে গতি হারিয়েছে শেয়ারবাজার। সরকারের অর্থ উপদেষ্টা বলছেন, প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে এ খাতে পুনরায় গতি ফিরে আসবে। যদিও সংকটে থাকা বিনিয়োগকারীরা সরকারের আশ্বাসে আস্থা রাখতে পারছে না। তবে বাজারসংশ্লিষ্ট ও বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেটে পুঁজিবাজার বিষয়ে যেসব প্রস্তাবনা এসেছে এবং পুঁজিবাজার সংস্কারে সরকারের উদ্যোগগুলো সঠিক বাস্তবায়ন ও তদারকি থাকলে ক্ষত সেরে পর্যায়ক্রমে চাঙ্গা হয়ে উঠবে শেয়ারবাজার।
জানা গেছে, প্রস্তাবিত বাজেটে ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠানের সিকিউরিটিজ লেনদেনের ওপর উৎসে করের হার শূন্য দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে শূন্য দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ প্রস্তাব করা হয়েছে; তালিকাভুক্ত ও অতালিকাভুক্ত কোম্পানির করের পার্থক্য আড়াই শতাংশ বৃদ্ধি করে সাড়ে ৭ শতাংশের প্রস্তাব করা হয়েছে এবং মার্চেন্ট ব্যাংকের জন্য করপোরেট করের হার ১০ শতাংশ কমিয়ে ২৭ দশমিক ৫০ শতাংশের প্রস্তাব করা হয়েছে। বাজেটে পুঁজিবাজারসংশ্লিষ্ট এসব সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে স্টক এক্সচেঞ্জ, ব্রোকারেজ হাউজ মালিক, মার্চেন্ট ব্যাংক ও বাজার বিশ্লেষকরা।
বাজেট এ ছাড়া বাংলাদেশ সিকিউরিটিস অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) বর্তমান কমিশন দায়িত্ব গ্রহণের পর বিনিয়োগকারীদের বিও অ্যাকাউন্টের ওপর ধার্য করা বার্ষিক ব্যবস্থাপনা খরচ ৪৫০ টাকা থেকে কমিয়ে ১৫০ টাকা করেছে এবং সিসি অ্যাকাউটে অর্জিত সুদের ২৫ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে ব্যয়ের জন্য ইনভেস্টর্স প্রটেকশন ফান্ডে জমার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।
অন্যদিকে ২০২৪ সালের ৪ নভেম্বর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ব্যক্তি বিনিয়োগকারীদের তালিকাভুক্ত কোম্পানি থেকে অর্জিত ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত মূলধনী আয় সম্পূর্ণ করমুক্ত বিধান অব্যাহত রাখার পাশাপাশি ৫০ লাখ টাকার ওপরে মূলধনী আয়ের ওপর কর ১৫ শতাংশ হ্রাস করেছে।
পুঁজিবাজার বিষয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম এক বিবৃতিতে বলেছেন, ২০২৫-২৬ সালের বাজেটে তালিকাভুক্ত ও অতালিকাভুক্ত কোম্পানির মধ্যে করহারের ব্যবধান বৃদ্ধি, মার্চেন্ট ব্যাংকের করহার হ্রাস এবং লেনদেনের ওপর উৎসে কর হ্রাস ইত্যাদি পুঁজিবাজারের জন্য ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ডিবিএ) প্রেসিডেন্ট সাইফুল ইসলাম বলেছেন, বাজেটে পুঁজিবাজার সংক্রান্ত এই প্রস্তাবের বাস্তবায়ন বাজারের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে বড় ভূমিকা রাখবে এবং এর ফলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারী, ইস্যুয়ার কোম্পানি, স্টক ব্রোকার, মার্চেন্ট ব্যাংকসহ পুঁজিবাজারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব অংশীজন ব্যবসায়িকভাবে লাভবান হবে।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আবু আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, বাজেটে যেসব বিষয় এসেছে, শেয়ারবাজারের জন্য তা ইতিবাচক বার্তা। পাশাপাশি দেশি-বিদেশি এবং স্থানীয় বড় কোম্পানির সঙ্গে সরকারি কোম্পানিকে তালিকাভুক্তির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ ধরনের উদ্যোগ এর আগে নেওয়া হলেও এবারের বিষয় একটু ভিন্ন। এজন্য একজন অভিজ্ঞ লোককে বিশেষভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সেখানেও সফলতা আসবে। এ ছাড়া জাতীয় নির্বাচনের সময় ঘোষণা করা হয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক জুলাই-সেপ্টেম্বরের সুদহার কমানোর ইঙ্গিত দিয়েছে। এসব বিষয় শেয়ারবাজার চাঙ্গা হওয়ার জন্য ইঙ্গিত বহন করছে। ফলে পর্যায়ক্রমে শেয়ারবাজার ভালো করবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
তবে সুদহারের বিষয়টি সমাধান না হলে বিনিয়োগ সম্ভাবনায় অনিশ্চয়তা থেকে যাবে বলে জানিয়েছেন অনেকে। তাদের মতে, শেয়ারবাজারের ৯০ শতাংশ সাধারণ বিনিয়োগকারী। তারা ব্যাংকে নিশ্চিত লাভ রেখে লোকসানের জন্য শেয়ারবাজারে আসবে না। আবার ব্যাংকের উচ্চ সুদের কারণে উদ্যোক্তারা নতুন নিয়োগের চিন্তা করবে না। ফলে শেয়ারবাজার ও বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের অনিশ্চয়তা থেকেই যাচ্ছে।
এদিকে আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশের নিচে নেমে আসবে বলে জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। মূল্যস্ফীতি কমলে সুদের হারও কমানো হবে বলেও জানান তিনি। বর্তমানে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ১৪ শতাংশ থেকে সাড়ে ৮ শতাংশে নেমে এসেছে। খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি সাড়ে ১১ শতাংশ থেকে কমে ৯ শতাংশের কিছু বেশি হয়েছে। আমি বিশ্বাস করি এই নিম্নমুখী প্রবণতা অব্যাহত থাকবে।
শেয়ারবাজারের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে ডিবিএর এক অনুষ্ঠানে সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, ‘অতীতে বাংলাদেশের কোনো সরকারই শেয়ারবাজারকে অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে ধারণ (আইডিবি) করেনি। এ কারণে শেয়ারবাজার সব সরকারের আমলে কমবেশি অবহেলিত ছিল। আর আওয়ামী লীগ সরকার শেয়ারবাজারকে রাজনৈতিকভাবে শোষণ করেছে। আগামী দিনে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে বিএনপি সরকার গঠন করলে আমরা শেয়ারবাজারকে “আইডিবি” করব। এটিকে অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তির অবস্থানে নিয়ে আসা হবে।’
জানা গেছে, পুঁজিবাজারের সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকট চিহ্নিত করতে সম্প্রতি বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করেছেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী। সভায় বিনিয়োগকারীদের পক্ষ থেকে পুঁজিবাজারে তারল্য সংকট নিরসনে নতুন ফান্ড আনয়ন ও সরকারকে পুঁজিবাজার সহায়ক ভূমিকা রাখতে অন্যান্য সরকারি সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে উদ্যোগ গ্রহণের কথা বলেছেন। পাশাপাশি লভ্যাংশ কর ও ক্যাপিটাল গেইন ট্যাক্স মওকুফকরণ, পুঁজিবাজারে ক্যাটাগরি পরিবর্তনের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের ক্ষতিগ্রস্ত না করা এবং তালিকাভুক্ত কোম্পানিকে আরও দায়বদ্ধ করা, পুঁজিবাজারে সব অনিয়ম-কারসাজির বিরুদ্ধে তদন্ত ও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ, ‘বাইব্যাক আইন’ বা শেয়ার পুনঃক্রয় আইন চালুর উদ্যোগ গ্রহণ, ইস্যুয়ার কোম্পানির অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ, মিউচ্যুয়াল ফান্ডের বিকাশ ও উন্নয়ন, পুঁজিবাজারে ভালো বহুজাতিক কোম্পানি এবং ভালো মৌলভিত্তিসম্পন্ন সরকারি-বেসরকারি কোম্পানিগুলো তালিকাভুক্তকরণে উদ্যোগের বিষয়ে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে সংস্কার, বিনিয়োগবান্ধব নীতিমালা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন, ইস্যুয়ার কোম্পানির আর্থিক বিবরণীর স্বচ্ছতা ও যথার্থতা নিশ্চিতকরণে ব্যবস্থা গ্রহণ, আইসিবির বাজার সহায়ক ভূমিকা নিশ্চিতকরণ, পুঁজিবাজারের সব স্তরে দক্ষতা-পেশাদারিত্ব নিশ্চিতকরণ, পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে বিনিয়োগকারীদের সংযোগ বৃদ্ধির প্রস্তাব করেন।
পুঁজিবাজার-সংক্রান্ত সরকারের মনোভাব তুলে ধরে বাজেট বক্তব্যে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, পুঁজিবাজারের সার্বিক উন্নয়ন, বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি এবং পুঁজিবাজারে আন্তর্জাতিক মানের সুশাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পুঁজিবাজার সংস্কার টাস্কফোর্স এবং পুঁজিবাজারের সঙ্গে সম্পৃক্ত ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে ‘পুঁজিবাজার সংস্কার ফোকাস গ্রুপ’ গঠন করা হয়েছে। টাস্কফোর্স ইতিমধ্যে সিকিউরিটিজ ও এক্সচেঞ্জ কমিশন (মিউচ্যুয়াল ফান্ড) বিধিমালা, ২০০১ এবং আইপিও-সংক্রান্ত বিধির বিষয়ে খসড়া সুপারিশমালা ও মার্জিন রুলস-সংক্রান্ত চূড়ান্ত সুপারিশ জমা দিয়েছে।
তিনি বলেন, বিগত সরকারের অনিয়ম, কারসাজি ও দুর্নীতির ফলে প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে পুনরায় গতি ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোতে সরকারের শেয়ার কমিয়ে পুঁজিবাজারে অন্তর্ভুক্তকরণ, বেসরকারি খাতের দেশীয় বড় কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির জন্য উৎসাহ প্রদান, বাজারে কারসাজি রুখতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন, অনিয়মের সঙ্গে জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনা এবং ব্যাংক ঋণের ওপর নির্ভরতা কমাতে পুঁজিবাজার থেকে বন্ড ও ইক্যুইটির মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহের সুযোগ বৃদ্ধি ইত্যাদি বিষয়ে কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
এ ছাড়া কমোডিটি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠা এবং পুঁজিবাজারের স্বচ্ছতা বৃদ্ধি ও বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষায় ব্লকচেইনভিত্তিক ব্যাক অফিস সফটওয়্যার বাস্তবায়নের কাজ চলমান রয়েছে। আশা করছি সংস্কার-সংক্রান্ত সুপারিশ বাস্তবায়ন এবং পুঁজিবাজারের অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে বিনিয়োগের এ গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরে পুনরায় গতি ফিরবে।