রাশিয়ার হয়ে যুদ্ধ করতে গিয়ে প্রাণ হারালেন রাজবাড়ীর সাবেক সেনা সদস্য
- নিজস্ব প্রতিবেদক
- প্রকাশঃ ০২:৫৭ পিএম, ০৯ অক্টোবর ২০২৫

রাশিয়ায় ইউক্রেন যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ হারিয়েছেন রাজবাড়ীর সাবেক সেনা সদস্য নজরুল ইসলাম (৪৭)। নিখোঁজ থাকার দীর্ঘ সাত মাস পর বুধবার (৮ অক্টোবর) বিকেলে তার মৃত্যুর খবর আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয় পরিবারকে। নিহত নজরুল রাজবাড়ী সদর উপজেলার রামকান্তপুর ইউনিয়নের চর রামকান্তপুর গ্রামের মৃত হাতেম আলী ফকিরের ছেলে।
পরিবার সূত্রে জানা গেছে, নজরুল ইসলাম বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ল্যান্স কর্পোরাল পদে কর্মরত ছিলেন এবং ২০২০ সালে অবসরে যান। এর আগে ২০১৩ সালে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে কঙ্গোতে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। অবসরের পর কিছুদিন বাড়িতে সময় কাটিয়ে স্থানীয়ভাবে বাঁধাই মালের ব্যবসা শুরু করেন, তবে সেই ব্যবসায় বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়েন।
পরবর্তী সময়ে স্থানীয় এক দালাল ফরিদ হোসেনের প্রলোভনে তিনি রাশিয়ায় “শপিং মলের নিরাপত্তাকর্মী” হিসেবে চাকরির আশায় বিদেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। পরিবারের আপত্তি উপেক্ষা করে নজরুল ২০২৫ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার উদ্দেশে রওনা দেন। সেখানে পৌঁছানোর পর তাকে এক মাসের সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে বাধ্য করা হয় এবং পরে পাঠানো হয় ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে।
প্রথম দিকে পরিবারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন নজরুল। স্ত্রী আইরিন আক্তারের সঙ্গে একসময় কথা বলার সময় তিনি বলেন, “এখান থেকে ফেরা আমার পক্ষে সম্ভব না। যদি ফোন বন্ধ দেখায়, ধরে নিও আমি আর নেই।”
পরিবারের সঙ্গে তার সর্বশেষ কথা হয় ৩০ এপ্রিল। সেদিন তিনি ব্যাংকে টাকা পাঠানোর কথা জানালেও কিছুক্ষণ পর আবার ফোন করে বলেন, “টাকা পাঠানো হলো না, দ্রুত যেতে হচ্ছে। যদি ফোন বন্ধ থাকে, ধরে নিও আমি বেঁচে নেই।” এরপর থেকে তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
দীর্ঘ সাত মাস ধরে পরিবারের সদস্যরা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন দপ্তরে যোগাযোগ করলেও কোনো উত্তর পাননি। অবশেষে গত বুধবার বিকেলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ফোনে জানানো হয়—নজরুল ইসলাম আর বেঁচে নেই।
নিহতের স্ত্রী আইরিন আক্তার বলেন, “আমার স্বামী অবসরের পর বাড়িতেই ছিলেন। ব্যবসায় ক্ষতির পর ফরিদের মাধ্যমে রাশিয়ায় যায়। আমি অনেকবার নিষেধ করেছিলাম, বলেছিলাম—আমাদের সঙ্গে থাকুক। কিন্তু সে বলেছিল, রাশিয়ায় ভালো বেতনের চাকরি পাবে, সংসারের অবস্থা বদলাবে। এখন চার মেয়েকে নিয়ে আমি কীভাবে বাঁচব, জানি না।”
নজরুলের বড় ভাই অবসরপ্রাপ্ত সার্জেন্ট রহিম অভিযোগ করে বলেন, “ফরিদ নামের দালাল আমার ভাইকে প্রলুব্ধ করে রাশিয়ায় পাঠিয়েছে। আমরা বহু জায়গায় খোঁজ নিয়েছি, ফরিদ বলত—ও বেঁচে আছে, শুধু যোগাযোগ করতে পারছে না। এখন শুনছি, ও মারা গেছে। সরকার অন্তত লাশটা যেন দেশে আনার ব্যবস্থা করে।”
তবে অভিযুক্ত দালাল ফরিদ হোসেন দাবি করেন, “আমি নজরুলকে পাঠাইনি, শুধু যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছি ‘বিকন ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস’ নামের এজেন্সির সঙ্গে। সে নিজেই জানত, রাশিয়ান সেনাবাহিনীর লজিস্টিক হ্যান্ড হিসেবে কাজ করবে। এমনকি ‘নো অবজেকশন সার্টিফিকেট’-এও স্বাক্ষর করেছে।”
রাজবাড়ী সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মারিয়া হক বলেন, “বিষয়টি এখনো আমার জানা নেই। তবে খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।”
চার কন্যাসন্তানকে রেখে না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন নজরুল ইসলাম। বড় মেয়ে রাজবাড়ী সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে, দ্বিতীয় মেয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে, আর ছোট দুই মেয়ের বয়স মাত্র ৬ ও ৫ বছর। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষকে হারিয়ে এখন শোকে স্তব্ধ তাদের পুরো পরিবার।