ভোরের স্বপ্ন কি আসলেই সত্যি হয়?


ভোরের স্বপ্ন কি আসলেই সত্যি হয়?

“ভোরে দেখা স্বপ্ন সত্যি হয়” - এই কথা বহু বছর ধরে মানুষের মুখে মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অনেকেই দাবি করেন, সকালে ঘুম ভাঙার ঠিক আগে দেখা স্বপ্ন বাস্তব জীবনের সঙ্গে হুবহু মিলে গেছে। কেউ একে ভবিষ্যদ্বাণী মনে করেন, কেউ আবার ভাগ্যের ইঙ্গিত হিসেবে দেখেন। কিন্তু আধুনিক ঘুম ও মস্তিষ্কবিজ্ঞান কী বলে? সত্যিই কি ভোরের স্বপ্ন কোনোভাবে ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারে?

ঘুম নিয়ে গবেষণায় পৃথিবীব্যাপী স্বীকৃত একটি নাম, ড. ম্যাথিউ ওয়াকার, যিনি ইউসি বার্কলে-র সেন্টার ফর হিউম্যান স্লিপ সায়েন্স-এর ডিরেক্টর। তাঁর গবেষণা বলছে, ঘুমের যে পর্যায়ে আমরা সবচেয়ে বেশি স্বপ্ন দেখি, সেটি হলো আরইএম (র‍্যাপিড আই মুভমেন্ট) ঘুম। এই সময় আমাদের মস্তিষ্ক কিছু অংশে অত্যন্ত সক্রিয় থাকে - বিশেষ করে আবেগ, স্মৃতি এবং চিত্র সংরক্ষণে যুক্ত অংশগুলো। আবার মস্তিষ্কের যুক্তিবোধ নিয়ন্ত্রণকারী অংশ, যেমন প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স, তখন তুলনামূলকভাবে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। এই কারণেই আরইএম ঘুমের স্বপ্ন হয় অনেক বেশি আবেগপ্রবণ, জীবন্ত এবং যুক্তির চেয়ে অনুভূতিপ্রবণ।

ভোরবেলা ঘুমের শেষ পর্যায়ে সবচেয়ে দীর্ঘ আরইএম সেশন ঘটে। সাধারণভাবে রাতের শেষভাগে এই পর্ব ৩০ থেকে ৯০ মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী হয়, যা দিনের অন্য সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। তাই ভোরবেলা দেখা স্বপ্ন আমাদের মনে বেশি থাকে এবং বেশি বাস্তব বলে মনে হয়। এই সময় ঘুম ভাঙলে স্বপ্নের রেশও সঙ্গে সঙ্গে মনে গেঁথে যায়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এমন স্বপ্নকে আমরা অন্য সময়ের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে ফেলি।

তবে বিজ্ঞানীরা একমত যে, এমন স্বপ্ন “সত্যি হয়ে যায়” এই বিশ্বাসের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। ড. অ্যালান হোবসন এবং ড. রবার্ট ম্যাকার্লি ১৯৭০-এর দশকে একটি তত্ত্ব দেন - অ্যাক্টিভেশন-সিন্থেসিস হাইপোথিসিস। তাঁদের মতে, আরইএম ঘুমের সময় আমাদের মস্তিষ্কের ভেতর থেকে এলোমেলো স্নায়বিক সিগনাল তৈরি হয়, যেগুলো আমাদের ব্রেইন কল্পনার মাধ্যমে একটি অর্থপূর্ণ গল্পে রূপান্তর করে। এই গল্পই আমরা স্বপ্ন হিসেবে দেখি। এর মানে স্বপ্নের মধ্যে ভবিষ্যদ্বাণী বা অলৌকিক কিছু থাকে না; বরং স্বপ্ন তৈরি হয় পূর্বের অভিজ্ঞতা, বর্তমান আবেগ এবং মস্তিষ্কের স্বয়ংক্রিয় কার্যকলাপের সমন্বয়ে।

তবে প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে অনেক সময় স্বপ্নের সঙ্গে বাস্তবের মিল কীভাবে ঘটে? সাইকোলজিস্টরা বলেন, এর পিছনে আছে কনফার্মেশন বায়াস - আমরা যে স্বপ্ন বাস্তবে মিলে গেছে সেটাই মনে রাখি, বাকি অগণিত ভুল স্বপ্ন ভুলে যাই। আর যেহেতু ভোরের স্বপ্ন সবচেয়ে স্পষ্ট থাকে, তাই তার সঙ্গে বাস্তবের সামান্য মিল পেলেও মনে হয় যেন ঠিক সেটাই ঘটেছে।

বিভিন্ন গবেষণায় এটাও দেখা গেছে, আমাদের দৈনন্দিন জীবনের ঘটনা, মানসিক চাপ বা প্রত্যাশা আরইএম স্বপ্নে ঘুরে ফিরে আসে। এর মানে, স্বপ্ন অনেক সময় আমাদের মনের অবচেতন ভাবনা বা চাপের প্রতিফলন হতে পারে। কিন্তু তা কখনোই নির্ভুল ভবিষ্যদ্বাণী নয়।

সব মিলিয়ে বিজ্ঞান বলছে, ভোরবেলার স্বপ্ন বেশি মনে থাকে এবং আবেগময় হওয়ার কারণে আমাদের মনে গভীর ছাপ ফেলে। কিন্তু এই স্বপ্ন সত্যি হয়ে যায় - এমন কোনো সায়েন্টিফিক প্রুভ নেই। বরং এটি মস্তিষ্কের একটি স্বাভাবিক, বায়োলজিক্যাল প্রসেস। তাই ভোরবেলার স্বপ্নকে যদি ভবিষ্যতের ইঙ্গিত বলে না ধরে, বরং নিজের মেন্টাল স্টেট বোঝার একটি জানালার মতো বিবেচনা করা হয়, তবেই তার যথার্থ ব্যবহার করা সম্ভব।

ঢাকাওয়াচ২৪ডটকমে লিখতে পারেন আপনিও ফিচার, তথ্যপ্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, ভ্রমণ ও কৃষি বিষয়ে। আপনার তোলা ছবিও পাঠাতে পারেন [email protected] ঠিকানায়।
×