ঋণ জালিয়াতিতে সাবেক ভূমিমন্ত্রীসহ ২৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা
- নিজস্ব প্রতিবেদক
- প্রকাশঃ ০৬:৪৭ পিএম, ৩০ জুলাই ২০২৫

নথিভুক্ত কোনো প্রতিষ্ঠান ছাড়াই ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ গ্রহণ ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তার স্ত্রীসহ ২৭ জনের বিরুদ্ধে নতুন একটি মামলা দায়ের করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
দুদকের মহাপরিচালক আখতার হোসেন বুধবার (৩০ জুলাই) জানিয়েছেন, এই মামলাটি একই দিনে দায়ের করা হয়েছে।
মামলায় যেসব ব্যক্তিদের আসামি করা হয়েছে, তাদের মধ্যে রয়েছেন—সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী, তার স্ত্রী ও ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) সাবেক চেয়ারম্যান রুকমীলা জামান, ব্যাংকের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান বজল আহমেদ বাবুল, সাবেক পরিচালক আনিসুজ্জামান চৌধুরী, আখতার মতিন, ইউনুছ আহমদ, নুরুল ইসলাম চৌধুরী, আসিফুজ্জামান চৌধুরী, রোকসানা জামান চৌধুরী, বশির আহমেদ, আফরোজা জামান, সৈয়দ কামরুজ্জামান, মো. শাহ আলম, প্রফেসর ড. মো. জোনাইদ শফিক, ড. কনক কান্তি সেন, ড. অপরূপ চৌধুরী এবং সাবেক পরিচালক তৌহিদ সিপার রফিকজ্জামান।
এছাড়া মামলায় আসামি হয়েছেন ইউসিবির সাবেক কর্মকর্তা আবু হেনা মো. ফখরুল ইসলাম, সাবেক ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. মোয়াজ্জেম হোসেন, সাবেক ক্রেডিট অফিসার জিয়াউল করিম খান, সাবেক এফএভিপি ও ক্রেডিট ইনচার্জ মোহাম্মদ আব্দুল আউয়াল, সাবেক অপারেশন ম্যানেজার মীর মেসবাহ উদ্দীন হোসাইন, চট্টগ্রাম পোর্ট শাখার সাবেক প্রধান আব্দুল হামিদ চৌধুরী, এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিক—মোহাম্মদ মিছাবাহুল আলম (মডেল ট্রেডিং), মো. আব্দুল আজিজ (ইম্পেরিয়াল ট্রেডিং), ও শাহরিয়ার হোসেন (আরমিট থাই অ্যালুমিনিয়ামের ডিজিএম)।
দুদকের অনুসন্ধান বলছে, বাস্তবে 'রিলায়েবল ট্রেডিং' নামে কোনো কোম্পানি না থাকলেও ইউসিবির চট্টগ্রাম পোর্ট শাখার কর্মকর্তারা যাচাই ছাড়াই একটি ব্যাংক হিসাব খুলে দেন। পরে, ওই ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে টাইম লোনের আবেদন করা হলে ব্যাংক কর্মকর্তারা ভুয়া পরিদর্শন প্রতিবেদন তৈরি করেন এবং শাখার ক্রেডিট কমিটি যাচাই না করেই সেই প্রতিবেদনসহ ঋণ প্রস্তাব পাঠায় প্রধান কার্যালয়ে।
প্রধান কার্যালয়ের ক্রেডিট কমিটিতে ঋণ প্রস্তাবে নয়টি নেতিবাচক পর্যবেক্ষণ থাকা সত্ত্বেও ইউসিবির ৪৫৪তম পরিচালনা পর্ষদ সভায় ঋণটি অনুমোদন করা হয়। অনুমোদনের পর, রিলায়েবল ট্রেডিংয়ের কথিত মালিক হিসেবে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর মালিকানাধীন আরমিট গ্রুপের একজন কর্মচারীকে দেখানো হয়। পরে তার অনুপস্থিতিতে এবং স্বাক্ষর জালিয়াতির মাধ্যমে ওই ঋণের পুরো অর্থ ভুয়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর ও রূপান্তর করা হয়। পরবর্তীতে, সেই অর্থ সরিয়ে এনে আরমিট সিমেন্ট পিএলসি এবং আরমিট থাই অ্যালুমিনিয়াম লিমিটেড–এর ব্যাংক হিসাবগুলোতে জমা দেওয়া হয়।
এই ঘটনায় সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৪০৬, ৪০৯, ৪২০, ৪৬৭, ৪৬৮, ৪৭১ ও ১০৯ ধারার পাশাপাশি দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭-এর ৫(২) ধারা এবং মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২-এর ৪(২)(৩) ধারায় মামলা করা হয়েছে।
এর আগে, গত ২৪ জুলাই ভিশন ট্রেডিং নামে একটি অপ্রকাশিত প্রতিষ্ঠানের নামে ভুয়া ঋণ অনুমোদন করিয়ে ২৫ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তার স্ত্রীসহ ইউসিবির সাবেক চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের নাম অন্তর্ভুক্ত করে মোট ৩১ জনের বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা করেছিল দুদক।
এরও আগে, ১৭ এপ্রিল আরও একটি মামলা করে দুদক। সেই মামলায় সাইফুজ্জামান চৌধুরী, তার স্ত্রীসহ ২৩ জনকে আসামি করে বলা হয়, ইম্পেরিয়াল ট্রেডিং, ক্লাসিক ট্রেডিং ও মডেল ট্রেডিং নামের মিথ্যা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ২০ কোটি টাকার ঋণ তুলে আত্মসাৎ করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, কাতারভিত্তিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আল-জাজিরা ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে 'দি মিনিস্টার'স মিলিয়নস' শিরোনামে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যেখানে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বিদেশে বিপুল সম্পদ থাকার দাবি করা হয়। সেই প্রতিবেদনে বলা হয়, তার বিদেশে মোট সম্পদের আনুমানিক মূল্য প্রায় ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং এর মধ্যে যুক্তরাজ্যেই রয়েছে ৩৬০টি বাড়ি।
এই প্রতিবেদন প্রকাশের পর, দুর্নীতি দমন কমিশন তার সম্পদ অনুসন্ধানে নামে। পরবর্তীতে, আদালতের নির্দেশে সাইফুজ্জামান ও তার স্ত্রীর নামে যুক্তরাজ্যে ৩৪৩টি, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ২২৮টি, যুক্তরাষ্ট্রে ৯টি এবং অন্যান্য দেশে থাকা সম্পত্তি ফ্রিজ ও ক্রোক করার আদেশ দেওয়া হয়।
পাশাপাশি, গত ৫ মার্চ এক আদালত আদেশে সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তার পরিবারের নামে থাকা ৩৯টি ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করা হয়, যেখানে মোট ৫ কোটি ২৬ লাখ ৮৩ হাজার টাকা রয়েছে। একইসঙ্গে, আদালত ১০২ কোটি টাকার শেয়ার এবং ৯৫৭ বিঘা জমি জব্দের নির্দেশ দেন।
সবশেষে, ২০২৪ সালের ৭ অক্টোবর আদালতের নির্দেশে সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তার স্ত্রীর দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।