বাণিজ্যকে অস্ত্রে রূপান্তর করেছেন ট্রাম্প: রেহমান সোবহান
- নিজস্ব প্রতিবেদক
- প্রকাশঃ ০২:২৩ পিএম, ০৯ এপ্রিল ২০২৫

ট্রাম্প প্রশাসনের অন্যায্য শুল্ক আরোপের কারণে বাংলাদেশের রপ্তানি কমতে পারে। দুই দেশের বাণিজ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ছয় বিলিয়ন ডলারের যে ঘাটতি রয়েছে, অপ্রয়োজনীয় আমদানি দিয়ে তা মেটানো সম্ভব নয়। এ পরিস্থিতিতে রপ্তানি বাণিজ্যে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের বিকল্প বাজার সন্ধান করতে হবে। এশিয়ার বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে উদীয়মান পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো বাংলাদেশের পণ্যের ভালো বিকল্প বাজার হতে পারে। এজন্য রপ্তানি পণ্যের তালিকায় বৈচিত্র্য আনতে হবে।
রপ্তানি বাণিজ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বাড়তি শুল্কের প্রভাব-সংক্রান্ত এক আলোচনায় সভায় গতকাল মঙ্গলবার (৮ এপ্রিল) এমন পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান।
ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্ক আরোপের সমালোচনায় তিনি বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বাণিজ্যের বিষয়টিকে এখন অস্ত্রে রূপান্তরিত করেছেন। এটিকে তিনি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চান। এ ধরনের শুল্ক আরোপ অন্যায্য এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নীতির প্রতি চরম অবহেলা। এ ধরনের পদক্ষেপ থেকে কেউ লাভবান হবে না। খোদ যুক্তরাষ্ট্র এ পদক্ষেপ থেকে কোনো সুফল পাবে না। শেষ পর্যন্ত এ শুল্ককাঠামো টেকসই নাও হতে পারে।’
আলোচনা সভার আয়োজন করে গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই)। রাজধানীর বনানীর নিজস্ব কার্যালয়ে সভা পরিচালনা করেন পিআরআইর চেয়ারম্যান ড. জাইদী সাত্তার। অনলাইনে যুক্ত হয়ে প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন গবেষণা সংস্থা সানেমের নির্বাহী পরিচালক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান ও গবেষণা সংস্থা র্যাপিডের চেয়ারম্যান ড. আব্দুর রাজ্জাক।
রেহমান সোবহান আরও বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের ‘ঘোর’ কাটাতে হবে। ওই বাজারটি গতকালের জন্য ছিল, আগামী দিনের হবে না। সময় এসেছে অতীত ভুলে আগামীর দিকে তাকানোর। কীভাবে নতুন বাজার সৃষ্টি করা যায়, সে কৌশল নিয়ে ভাবতে হবে। পূর্বমুখী নীতি নিতে হবে। কারণ, এর মধ্যে ভূ-অর্থনীতি, ভূ-রাজনীতির বিষয় আছে। যুক্তরাষ্ট্র তার অভ্যন্তরীণ পণ্য এবং বাজার সুরক্ষা দেওয়ার নীতি নিয়েছে। তবে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুধু শুল্কই নয়, উন্নয়ন সহায়তা, জলবায়ু তহবিল- এ রকম অন্যান্য ইস্যুতেও আলোচনা দরকার।’
ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্ক নির্ধারণের পদ্ধতির সমালোচনা করে অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, ‘এক সময় যুক্তরাষ্ট্রই বিশ্বায়নের ধারণা সৃষ্টি করেছিল, আজ তারাই সে ব্যবস্থা ছুড়ে ফেলে দিচ্ছে। এ বাস্তবতার মধ্যে টিকে থাকতে হবে। এত দিন বিশ্বব্যবস্থা একভাবে চলেছে; এখন বিশ্বব্যবস্থা আরেকভাবে চলবে। অর্থনীতির সমস্যা এখন আর অর্থনীতির নিয়মে সমাধান করা হচ্ছে না, বরং যারা সবচেয়ে ভালো আলোচনা বা চুক্তি করতে পারবে, তারাই টিকে থাকবে।’
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি প্রসঙ্গে অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, ‘ট্রাম্প যে প্রক্রিয়ায় বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে চান, সেভাবে ঘাটতি কমানো একটা অসম্ভব ব্যাপার। বাংলাদেশও যেভাবে উচ্চ শুল্কের খড়্গ থেকে বাঁচতে রপ্তানি বাড়ানোর কথা বলেছে, তা বাজার অর্থনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রকে শুল্কছাড় সুবিধা দিলে অন্য উন্নয়ন অংশীদাররাও একই সুবিধা চাইতে পারে। এছাড়া মুক্তবাজার অর্থনীতিতে কেউ কাউকে বাণিজ্যের জন্য চাপ দিতে পারে না। যেখান থেকে পণ্য প্রতিযোগিতামূলক হয় সেখান থেকে পণ্য আনবে। হুকুম দিয়ে আমদানি বাড়ানো সম্ভব নয়।’
সভায় জাইদী সাত্তার বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র বড় অর্থনীতির দেশ, সেটি ঠিক। তবে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়ানোর সুযোগ আছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানি করতে হবে, তা আবশ্যক নয়। রপ্তানি বাজারে বৈচিত্র্য আনতে পণ্যেরও বৈচিত্র্য আনা প্রয়োজন। এছাড়া সহায়ক শুল্কনীতি দরকার। বর্তমান শুল্কনীতি রপ্তানি সহায়ক নয়, বরং উল্টো। রপ্তানির চেয়ে অভ্যন্তরীণ বাজারে বাজারজাত করতে মুনাফা ও সুবিধা এখানে বেশি। তিনি বলেন, ট্রাম্প প্রশাসন বলেছে, শুল্কের বাইরে কিছু অশুল্ক বাধা আছে। নিয়মনীতিতে স্বচ্ছতা নেই। দুর্নীতি আছে, মেধাস্বত্ব অধিকার নেই- এ বিষয়গুলোতে মনোযোগ দেওয়া দরকার।’
আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রকে খুশি করতে শুল্ক কমানো হলে ৩ বিলিয়ন ডলারের মতো অপ্রয়োজনীয় আমদানি করতে হবে; যা একরকম ‘ঘুষ দিতে বাধ্য’ করার মতো। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে যে নীতির ভিত্তিতে শুল্ক আরোপ করেছে তার ভিত্তি নেই। সারা পৃথিবীর ওপর গড়ে ২২ শতাংশ ট্যারিফ বাড়িয়েছে তারা। এতে দেশটিতে পোশাকের দাম ১০ শতাংশ বাড়বে ও চাহিদা ৩২ শতাংশ কমবে। হোয়াইট হাউসের প্রতিবেদন বলছে, এতে পোশাকের চাহিদা ৩২ বিলিয়ন ডলার কমতে পারে। শেষ পর্যন্ত ট্রাম্প হয়তো শুল্কখড়গ নীতি ধরে রাখতে পারবেন না। তাঁকে সরে আসতে হবে। তবে এ ধরনের প্রবণতা আগামীতেও থাকবে। অসম দরকষাকষি চলতে থাকবে। চীনকে শায়েস্তা করতে দেশটির পণ্যে সর্বোচ্চ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিযোগী সক্ষমতা কমায় চীন ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) দিকে নজর দেবে এবং সস্তায় এ অঞ্চলে পোশাক সরবরাহ করবে। তখন ইইউর বাজারে বাংলাদেশি রপ্তানি কঠিন প্রতিযোগিতার মুখে পড়বে।’
সেলিম রায়হান বলেন, ‘আকস্মিকভাবে ট্রাম্প প্রশাসন শুল্ক আরোপ করেনি। উন্নয়ন সহায়তা বন্ধ ও শুল্ক আরোপ একই সূত্রে গাঁথা। বিশ্ব হয়তো নতুন বিশ্বব্যবস্থায় প্রবেশ করতে যাচ্ছে। আগামীতে এ ধরনের অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত পদক্ষেপ আসতে পারে। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ শুল্কনীতির সংস্কার করছে। শুধু শুল্কনীতি সংস্কার যথেষ্ট নয়। এর সঙ্গে অন্য নীতিগত ও প্রশাসনিক সংস্কার প্রয়োজন আছে। তিনি আরও বলেন, ট্রাম্প ডব্লিউটিওকে পাত্তা দিচ্ছেন না। সংস্থাটির আপিল কার্যক্রম অকার্যকর করে ফেলা হয়েছে। এ অবস্থায় দ্বিপক্ষীয় সমঝোতা এবং দরকষাকষির মাধ্যমে এগোতে হবে। মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) হতে পারে একটি অস্ত্র। বাংলাদেশ এখানেও পিছিয়ে আছে। ভিয়েতনাম ১৫ দেশের সঙ্গে এফটিএ করেছে। বাংলাদেশ করেছে শুধু ভুটানের সঙ্গে।’
উন্মুক্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে সিপিডির ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্কনীতি এবং স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) কাতার থেকে উত্তরণের মুহূর্তে এখন রপ্তানির বাজার ধরে রাখতে নতুন বাজার খোঁজা এবং পণ্য বহুমুখীকরণে নজর দিতে হবে।’
তিনিও নতুন বাজার হিসেবে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর কথা বলেন।
রপ্তানিকারক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি এবং ইভিন্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে যে কোনো সুবিধা আদায়ে লবিস্ট নিয়োগ করতে হয়। অন্যান্য দেশ তাই করছে। বাংলাদেশকেও ভাবতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্যতা থাকায় তিনি নিজে আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন।’
শাশা ডেনিমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামস মাহমুদ বলেন, ‘দুই মাস আগে শুল্কনীতি বিষয়ে ট্রাম্প ধারণা দিলেও বাংলাদেশ তা গুরুত্বের সঙ্গে নেয়নি।’