‘তাদের বিচার আল্লাহ করবে’: জোরপূর্বক চুল কাটার শিকার সেই বৃদ্ধ
- ময়মনসিংহ প্রতিনিধি
- প্রকাশঃ ১১:২৯ এম, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এক ভিডিওতে দেখা যায়, কয়েকজন ব্যক্তি জোরপূর্বক এক বৃদ্ধের চুল কেটে দিচ্ছেন। ভিডিওতে অসহায় অবস্থায় ওই বৃদ্ধ নিজের চুল রক্ষা করার জন্য বহুক্ষণ চেষ্টা করেন, কিন্তু ব্যর্থ হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “আল্লাহ, তুই দেহিস।”
ঘটনাটি ঘটেছে ময়মনসিংহ জেলার তারাকান্দা থানার কোদালিয়া গ্রামে। চার মাস আগে ঘটলেও এটি সম্প্রতি ভাইরাল হওয়ার পর ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়।
ভিডিওতে দেখা যায়, ষাটোর্ধ এক বয়স্ক ফকির লাঠি ও ব্যাগ হাতে একটি দোকানের দিকে যাচ্ছিলেন। তার মাথায় লম্বা জটা পাকানো চুল এবং মুখে দাড়ি ছিল। হঠাৎ তিনজন ব্যক্তি তাকে ধাওয়া করে জোরপূর্বক রাস্তার পাশে নিয়ে যায়। বৃদ্ধটি শারীরিকভাবে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করলেও সফল হননি।
চুল কাটার সময় তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “আল্লাহ, আল্লাহ তুই দেহিস।” কিন্তু তিন ব্যক্তি তার কান্নায় সাড়া না দিয়ে মাথার সব চুল কেটে দেন।
ভুক্তভোগী হালিম উদ্দিন আকন্দ জানান, ঘটনার দিন সকালে তিনি বাজারে একটি চায়ের দোকানে বসেছিলেন। তখন কিছু লোক তাকে জোর করে চা-নাশতা খাওয়াতে চান। তিনি রাজি না হলে তারা টেনে বাইরে নিয়ে গিয়ে ট্রিমার দিয়ে তার মাথার চুল ও দাড়ি কেটে দেন।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, সিলেটের হযরত শাহজালালের মাজারে যাওয়ার পর থেকে আর কখনো চুল কাটেননি। তার চুল ছিল প্রায় ৩০ বছরের পুরোনো। চুল কাটার পর থেকে তিনি বিভিন্ন শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন।
তিনি বলেন, “হেই থাইক্কা আমি কামকাজ করতে পারি না, বাজারে আইতারি না, ঘরবৈঠক আমি। রোগী ঝাড়তে পারি না। আসকা মাইরা শইল বেহুঁশ হইয়া যায়, মাথাত পানি ঢালন লাগে।”
বিচার চান কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “তাদের বিচার আল্লাহ করবে। সামাজিকভাবে আমি অনেক হেয় প্রতিপন্ন হয়েছি। সারা বিশ্বের লোক আমাকে দেখেছে। বিষয়টি নিয়ে আমি খুবই মর্মাহত হয়েছি।”
স্থানীয় বাসিন্দা হাসিবুদ্দিন জুয়েল জানান, একটি হিউম্যানিটি সংস্থার কিছু টুপি-দাড়িওয়ালা ব্যক্তি হালিম ফকিরকে ধরে নিয়ে গিয়ে তার চুল-দাড়ি কেটে দেয়। শত শত লোক তা দেখলেও কেউ এগিয়ে আসেনি।
হালিমের বড় ছেলে হাবিব বলেন, “আমার বাবা দীর্ঘদিন চুল দাড়ি কাটেন না, তাতে কোনো সমস্যা ছিল না। সম্প্রতি ঢাকা থেকে কিছু লোক এসে জোর করে তার জটলা চুল-দাড়ি কেটে দেয়। এখন তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত এবং লজ্জায় ঘর থেকে বের হন না।”
এই ঘটনার পর সামাজিকমাধ্যম ও বিভিন্ন মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
ময়মনসিংহ জজ কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট শাজাহান কবির বলেন, “ময়মনসিংহের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং লোকশিল্পের ধারক-বাহক হালিম ফকিরের ওপর যে বর্বরোচিত ঘটনা ঘটেছে, তা অত্যন্ত নিন্দনীয় এবং দুঃখজনক।”
বাউল সমিতির সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম আসলাম বলেন, “আইনের দৃষ্টিতে এটি গুরুতর অপরাধ। এটি কেবল ব্যক্তিগত আক্রমণ নয়, বরং মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি এবং সমাজে নৈরাজ্য সৃষ্টির অপচেষ্টা।”
আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এক বিবৃতিতে এই ঘটনাকে “সম্পূর্ণ অমানবিক, বেআইনি এবং সংবিধান ও মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন” বলে উল্লেখ করেছে।
আসক জানায়, এই ঘটনা ব্যক্তি স্বাধীনতা ও মর্যাদার ওপর সরাসরি আঘাত। এটি সমাজে আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করছে।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩১, ৩২ ও ৩৫ অনুযায়ী, প্রতিটি নাগরিকের আইনের আশ্রয়ে মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপন, জীবনের নিরাপত্তা এবং নিষ্ঠুর আচরণ থেকে সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার রয়েছে।
তারাকান্দা থানার ওসি মোহাম্মদ টিপু সুলতান জানান, হালিম ফকির এলাকায় কবিরাজি করেন। তিনি নিশ্চিত করেন, ঈদুল আজহার আগে ঢাকা থেকে আসা কিছু লোক তাকে জোর করে গোসল করিয়ে নতুন কাপড় পরিয়ে দিয়ে চুল কেটে দেয়।
তিনি আরও জানান, স্থানীয়রা ওই ব্যক্তিদের চেনেন না। জানা গেছে, তারা ইউটিউবার, যারা দেশের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে পাগল ও বৃদ্ধদের চুল-দাড়ি কেটে ভিডিও করে। এ বিষয়ে এখনো কোনো অভিযোগ আসেনি, তবে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়েছিল এবং অভিযুক্তদের শনাক্তে তৎপর রয়েছে।