
দীর্ঘদিন সুশৃঙ্খল রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিচিত জামায়াতে ইসলামী এবার প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে বিরল এক অস্থিরতার মুখে পড়েছে। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে দলটির ভেতরে প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য বিরোধ দেখা দিয়েছে, যা অতীতে কখনও ঘটেনি বলে দলীয় সূত্র নিশ্চিত করেছে।
জানা গেছে, চারটি আসনে খোলামেলা বিরোধ ও বিক্ষোভ হয়েছে, আর অন্তত আরও চারটি আসনে রয়েছে নেপথ্য অসন্তোষ। বিএনপি বা আওয়ামী লীগের মতো বড় দলের প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে বিরোধ নতুন কিছু নয়, তবে জামায়াতের ইতিহাসে এমন বিশৃঙ্খলা নজিরবিহীন।
দলটির কাঠামো অনুযায়ী রুকন, কর্মী ও সহযোগী সদস্য এই তিন স্তর থেকে ভোটের মাধ্যমে প্রার্থী নির্ধারণ করা হয় এবং তা কেন্দ্রীয়ভাবে অনুমোদন পায়। স্থানীয় নির্বাচনে এই প্রক্রিয়াই সব সময় মেনে চলা হলেও এবার ভিন্ন চিত্র দেখা যাচ্ছে।
পাবনা-৫, ময়মনসিংহ-৬, কুমিল্লা-৭ ও নরসিংদী-৫ আসনে প্রকাশ্য বিক্ষোভ ও প্রার্থীর বিরুদ্ধে ক্ষোভ দেখা গেছে। এ ছাড়া সিলেট-৫, কুষ্টিয়া-৩, চট্টগ্রাম-১৫ ও গাজীপুর-৬ আসনে বিরোধ দানা বেঁধেছে বলে জানা গেছে। কুমিল্লার আরও দুটি আসনেও অসন্তোষের গুঞ্জন রয়েছে।
কেন এমন পরিস্থিতি তৈরি হলো, সে বিষয়ে জানতে চাইলে জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের বলেন, “সমর্থক পর্যায়ের কিছু লোক অনাকাঙ্ক্ষিত কাজ করেছে। তারা দলীয় শৃঙ্খলা সম্পর্কে ততটা ভালো জানেন না। তবে জামায়াত এগুলোকে প্রশ্রয় দিচ্ছে না। কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। রুকন পর্যায়ের কোনো জনশক্তি এসব তৎপরতায় জড়িত নয়।”
ময়মনসিংহ-৬ (ফুলবাড়িয়া) আসনে মনোনয়ন না পেয়ে ক্ষুব্ধ হয়েছেন সাবেক জেলা আমির অধ্যাপক জসিম উদ্দিন। তাঁর সাংগঠনিক পদসহ রুকনিয়াত স্থগিত করা হয়েছে। ২০০১ সালে চারদলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িপাল্লা প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নেওয়া এই নেতা এবারও মনোনয়ন চেয়েছিলেন। কিন্তু জেলা নায়েবে আমির অধ্যক্ষ কামরুল হাসান মিলনের নাম ঘোষণার পর জসিম উদ্দিনের সমর্থকেরা বিক্ষোভ মিছিল করে মিলনকে ফুলবাড়ীতে “অবাঞ্ছিত” ঘোষণা করেন।
জসিম উদ্দিন দাবি করেছেন, তিনি ওই ঘটনায় জড়িত নন এবং দলীয় প্রার্থীকে সমর্থন করছেন। তবে স্থানীয় নেতারা জানান, পদ স্থগিতের পর তিনি কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন। প্রার্থী কামরুল হাসান মিলন বলেন, “নেতাকর্মী সবাই ভোটের প্রচারে ঐক্যবদ্ধ। যে দুই-একজন এখনও সক্রিয় নন, তারাও নির্বাচনের সময় দলের পাশে থাকবেন।”
অন্যদিকে ২৭ অক্টোবর কুমিল্লার চান্দিনায় উত্তর জেলা জামায়াতের গণমিছিলে দুই পক্ষের মধ্যে হাতাহাতি ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। একপক্ষ অভিযোগ করে, সম্ভাব্য প্রার্থী মাওলানা মোশাররফ হোসেন আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ। তাঁকে উদ্দেশ করে বিক্ষোভকারীরা স্লোগান দেন, “দল বিক্রি চলবে না, আওয়ামী দোসর প্রার্থী মানি না।”
জেলা পর্যায়ের কিছু নেতার বিরুদ্ধে প্রার্থী তালিকা পরিবর্তনের অভিযোগ তুলেছেন ছাত্রশিবিরের সাবেক নেতারা। চান্দিনা উপজেলা শিবিরের সাবেক সভাপতি সাজিদ আল-আমিন বলেন, “জেলা আমির ও সেক্রেটারি অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে মোশাররফ হোসেনকে প্রার্থী ঘোষণা করেছেন।”
অভিযোগ অস্বীকার করে মোশাররফ হোসেন বলেন, “স্থানীয় মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হিসেবে সরকারি অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে হতো। সেই ছবিগুলো ব্যবহার করে আমাকে আওয়ামী দোসর বলা হচ্ছে। যারা এই অভিযোগ তুলছে, তারা নির্বাচনের মাঠে নেই।”
জামায়াতের এক কেন্দ্রীয় নেতা মন্তব্য করেন, চান্দিনার ঘটনা দলের ইতিহাসে সবচেয়ে উদ্বেগজনক। “৮৪ বছরের ইতিহাসে এমন বিশৃঙ্খলা হয়নি। আমরা বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি। প্রার্থী বদল করা হবে না, এতে নেতিবাচক বার্তা যাবে।”
পাবনা-৫ আসনেও একই ধরনের উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। স্থানীয় একাংশ সম্ভাব্য প্রার্থী মাওলানা ইকবাল হোসেনকে বাদ দিয়ে কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা সদস্য আব্দুর রহিমকে প্রার্থী করার দাবি তুলেছেন। তাঁদের অভিযোগ, ইকবাল হোসেন ৫ আগস্টের পর বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়েছেন।
চট্টগ্রাম-১৫ আসনে জামায়াতের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত এলাকায়ও নীরব অসন্তোষ দেখা গেছে। এক সময়ের জনপ্রিয় নেতা শাহজাহান চৌধুরীর নাম গত জুনে ঘোষণা করা হলেও, তিনি এখনও প্রকাশ্যে প্রচারণায় অংশ নেননি। দলীয় নেতারা বিভাজনের অভিযোগ অস্বীকার করলেও মাঠ পর্যায়ে নীরব অস্বস্তি রয়েছে।
কুষ্টিয়া-৩ আসনে প্রার্থী পরিবর্তন নিয়েও বিতর্ক চলছে। জানুয়ারিতে মজলিসে শূরা সদস্য ফরহাদ হুসাইনকে প্রার্থী করা হলেও পরে ওয়াজের বক্তা আমির হামজাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের প্রশংসা করে বিতর্কে জড়ানো এই বক্তা এখন দলীয় নীরবতার নির্দেশে রয়েছেন। স্থানীয় সূত্র বলছে, তৃণমূলের একটি বড় অংশ তাঁর প্রার্থিতা মেনে নিচ্ছে না।
সিলেট-৫ আসনেও মনোনয়ন নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে। ২০০১ সালের সাবেক এমপি ফরিদউদ্দিন চৌধুরীর পরিবর্তে এবার আনোয়ার হোসেন খানকে মনোনয়ন দেওয়ায় স্থানীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে বিভাজন দেখা দিয়েছে। শিবিরের এক সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, “নতুন প্রার্থী স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী নন। এতে জয়ের সম্ভাবনা ক্ষীণ হতে পারে।”
নবগঠিত গাজীপুর-৬ আসনে তুরস্কে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা করা ড. হাফিজুর রহমানকে মনোনীত করেছে কেন্দ্র। কিন্তু স্থানীয় নেতারা অভিযোগ করেছেন, তৃণমূলের মতামত নেওয়া হয়নি। তাঁদের আশঙ্কা, হঠাৎ আসা এই প্রার্থীকে স্বল্প সময়ে জনগণের কাছে পরিচিত করা কঠিন হবে।