আ.লীগের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারসহ ১২ সুপারিশ প্রধান উপদেষ্টাকে


আ.লীগের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারসহ ১২ সুপারিশ প্রধান উপদেষ্টাকে

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে একটি যৌথ খোলা চিঠি দিয়েছে, যেখানে আওয়ামী লীগের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারসহ মোট ১২টি সুপারিশ গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়েছে। তারা একই সঙ্গে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, যেমন মৌলিক স্বাধীনতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, আইনি সংস্কার শুরু এবং গুমসহ অন্যান্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার তদন্ত কার্যক্রমের প্রশংসা করেছে।

এই খোলা চিঠিটি হিউম্যান রাইটস ওয়াচের নিজস্ব ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে। চিঠিতে উল্লেখিত ১২টি সুপারিশের মধ্যে রয়েছে বিচার ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ, নিরাপত্তা খাতের কাঠামোগত সংস্কার, গুমের মামলার তদন্ত ও সংশ্লিষ্ট কমিশনকে শক্তিশালী করা, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সংস্কার, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা সুরক্ষায় আইন পরিবর্তন, ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা ও নজরদারি সীমাবদ্ধকরণ, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে চালানো মামলার প্রত্যাহার, আওয়ামী লীগের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া, নাগরিক সমাজ ও এনজিওগুলোর স্বাধীনতা রক্ষা, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সঙ্গে (আইসিসি) সমন্বয় বৃদ্ধি করা।

চিঠির স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে রয়েছে সিভিকাস, কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস, ফর্টিফাই রাইটস, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, রবার্ট এফ. কেনেডি হিউম্যান রাইটস এবং টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউট। তারা চিঠির শুরুতেই সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে উল্লেখ করেছে, “জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের সময় বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর আমাদের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক করার জন্য আমরা আপনার প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। ২০২৬ সালের নির্বাচনের আগে অল্প সময়ের এই অন্তর্বর্তী সময়ে আমরা আপনাকে আহ্বান জানাই মানবাধিকার সুরক্ষা আরও বিস্তৃত করতে এবং বাংলাদেশে এমন শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে, যা স্বাধীন ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করবে এবং ভবিষ্যতে পুনরায় কর্তৃত্ববাদী শাসনের ঝুঁকি প্রতিহত করবে।”

তারা আরও উল্লেখ করেছে যে, নিরাপত্তা খাতে কাঠামোগত সংস্কার এখনও যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়নি এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক সদস্য এখনও জবাবদিহিতা ও সংস্কারের জন্য পুরোপুরি সহযোগিতা করছেন না। পূর্ববর্তী সরকারের সময় ঘটে যাওয়া মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য বিচারের ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি, তবে চলমান নির্বিচার গ্রেপ্তার এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলাগুলো, বিশেষত যেগুলো আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট বলে মনে হয় এবং যথাযথ প্রমাণ নেই, তা অবিলম্বে বন্ধ করার কথাও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

রোহিঙ্গা সংকট প্রসঙ্গে চিঠিতে বলা হয়, জাতিসংঘের রোহিঙ্গা বিষয়ক উচ্চপর্যায়ের সম্মেলনে ড. মুহাম্মদ ইউনূস রোহিঙ্গাদের স্বদেশ প্রত্যাবাসন একমাত্র সমাধান হিসেবে উল্লেখ করেন এবং ‘তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ’ হিসেবে নতুন আগত শরণার্থীদের ‘ফিরে যেতে দিতে হবে’ বলে জানান। রোহিঙ্গারা দীর্ঘদিন ধরে তাদের মাতৃভূমিতে ফেরার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে আসছেন। তবে ২০২৩ সালের শেষ থেকে বাংলাদেশে আগত প্রায় দেড় লাখ রোহিঙ্গাসহ মিয়ানমারে এখনও নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ এবং টেকসই প্রত্যাবাসনের জন্য যথাযথ পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে বসবাসরত সকলের অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষায় ১২ দফা সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে চিঠিতে।

সেগুলো হলো -

১. জবাবদিহিতা ও বিচারের নিশ্চয়তা: জুলাই বিপ্লব এবং গত পনেরো বছরে সংঘটিত গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন, যেমন: গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও নির্যাতনের জন্য দায়ীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে সেনা ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে গুম ও নির্যাতনকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে অভিযোগ গঠন ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। সেনাবাহিনীকে অবশ্যই এই বিচারের প্রতি পূর্ণ সহযোগিতা দিতে হবে এবং বেসামরিক আদালত হিসেবে আইসিটির এখতিয়ারকে সম্মান করতে হবে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে যে, আইসিটির আইনি কাঠামো, সম্পদ ও স্বাধীনতা যথেষ্ট শক্তিশালী হয়, যাতে রাজনৈতিক বা প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয় নির্বিশেষে আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে ন্যায়বিচার করা সম্ভব হয়। পাশাপাশি মৃত্যুদন্ড কার্যকরে সাময়িক স্থগিতাদেশ ঘোষণা করা উচিত।

২. নিরাপত্তা খাতে সংস্কার: র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) বিলুপ্ত করা এবং সেনা গোয়েন্দা সংস্থা (ডিজিএফআই)-এর ক্ষমতা সীমিত করা জরুরি, যাতে অতীতের দমনপীড়নের ধারা থেকে মুক্ত থেকে মানবাধিকারসম্মত নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যায়। র‌্যাবের অবাধ নির্যাতন, হত্যা ও গুমের ইতিহাস এই সংস্থাকে সংস্কারের বাইরে নিয়ে গেছে। সমস্ত সামরিক কর্মীকে বেসামরিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থেকে প্রত্যাহার করতে হবে। ডিজিএফআইয়ের ভূমিকা আইনি কাঠামো ও নিয়ন্ত্রণসহ স্পষ্টভাবে সামরিক গোয়েন্দা কার্যক্রমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে হবে।

৩. গুমের অপরাধ নির্ধারণ ও তদন্ত কমিশন শক্তিশালীকরণ: আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী গুমকে অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করতে হবে এবং ‘গুম প্রতিরোধ ও প্রতিকার অধ্যাদেশ’ অবিলম্বে পাস করতে হবে। তবে মৃত্যুদন্ড বাদ দিয়ে এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। গুম তদন্ত কমিশনকে পর্যাপ্ত সময় ও সম্পদ দিতে হবে, এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আটকস্থল ও রেকর্ডে পূর্ণ প্রবেশাধিকার দিতে হবে।

৪. জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের (এনএইচআরসি) সংস্কার: ‘প্যারিস প্রিন্সিপলে’র সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এনএইচআরসি’কে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, স্বাধীন ও কার্যকর করতে হবে। কমিশনকে নিরাপত্তা বাহিনীসহ রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তে পূর্ণ ক্ষমতা দিতে হবে।

৫. ব্যক্তির স্বাধীনতা রক্ষায় আইন সংস্কার: ২০২৫ সালের ‘সাইবার সিকিউরিটি অধ্যাদেশ’ ও অন্যান্য দমনমূলক আইন; যেমন: সন্ত্রাসবিরোধী আইন, বিশেষ ক্ষমতা আইন, অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট এবং ফৌজদারি আইনে মানহানির ধারা; আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মান অনুযায়ী বাতিল বা সংশোধন করতে হবে। ২০২৩ সালের সাইবার সিকিউরিটি আইন বাতিলের পরও নতুন অধ্যাদেশে অস্পষ্ট ও বিস্তৃত ধারা রয়েছে, যা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহারের ঝুঁকি সৃষ্টি করছে।

৬. ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা ও নজরদারি সীমিতকরণ: ‘পারসোনাল ডাটা প্রোটেকশন অধ্যাদেশ’ ও ‘ন্যাশনাল ডাটা ম্যানেজমেন্ট অধ্যাদেশ’-এর খসড়া আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী সংশোধন করতে হবে, যাতে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের জন্য অতিরিক্ত ছাড় না থেকে নাগরিকের গোপনীয়তা ও তথ্যনিরাপত্তা রক্ষা পায়।

৭. মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সাংবাদিক সুরক্ষা: সাংবাদিকদের রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের অজুহাতে হয়রানি, গ্রেপ্তার বা হামলা থেকে রক্ষা করতে হবে। গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে হবে, যা আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে।

৮. রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা প্রত্যাহার: অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে আগস্ট ২০২৪-এর আগে ও পরে দায়ের হওয়া সব রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা পর্যালোচনা করে বাতিল করতে হবে, বিশেষ করে যেগুলোর কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ নেই।

৯. আওয়ামী লীগের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার: সন্ত্রাসবিরোধী আইনের আওতায় আওয়ামী লীগের কার্যক্রমে যে সামগ্রিক নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে, তা অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে। এটি গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা ও বহুদলীয় রাজনীতির পথে বাধা সৃষ্টি করছে। জাতিসংঘের ফেব্রæয়ারি ২০২৫ সালের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং প্রতিবেদনে বলা হয়েছে: ‘গণতান্ত্রিক পুনঃপ্রতিষ্ঠার স্বার্থে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।’

১০. সিভিল সোসাইটি ও এনজিও স্বাধীনতা: এনজিও বিষয়ক ব্যুরো সংস্কার করতে হবে, যাতে এটি নাগরিক সংগঠনগুলোকে হয়রানি বা বিদেশি অর্থায়নে বাধা দেয়ার হাতিয়ার না হয়। বিদেশি অনুদান (স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রম) নিয়ন্ত্রণ আইন পুনর্বিবেচনা জরুরি।

১১. রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সুরক্ষা: রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জোরপূর্বক মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো বন্ধ করতে হবে। ক্যাম্পে চলাচল, জীবিকা ও শিক্ষার ওপর আরোপিত সীমাবদ্ধতা কমাতে হবে। সহায়তা কমে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে, এই সুযোগগুলো শরণার্থীদের মর্যাদা ও আত্মনির্ভরতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।

১২. আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) সঙ্গে সহযোগিতা: বাংলাদেশ-মিয়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে আইসিসি’র চলমান তদন্তে পূর্ণ সহযোগিতা করতে হবে এবং আদালতের ওয়ারেন্টে অভিযুক্ত কেউ বাংলাদেশে থাকলে তাকে হস্তান্তর করতে হবে।

ঢাকাওয়াচ২৪ডটকমে লিখতে পারেন আপনিও ফিচার, তথ্যপ্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, ভ্রমণ ও কৃষি বিষয়ে। আপনার তোলা ছবিও পাঠাতে পারেন [email protected] ঠিকানায়।
×