রোহিঙ্গা পরিচয় গোপন করে এনআইডি ও সরকারি চাকরি
- নিজস্ব প্রতিবেদক
- প্রকাশঃ ০৩:০৩ পিএম, ০৮ অক্টোবর ২০২৫

কক্সবাজারের সেন্টমার্টিনের কোনপাড়া এলাকায় রোহিঙ্গা যুবক আব্দুল আজিজ ভুয়া পরিচয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) সংগ্রহ করে সরকারি চাকরি করছেন—এমন তথ্য সামনে এসেছে। ২০১৭ সালে তিনি স্থানীয় বাসিন্দা আলী আহমদ ও নুর নাহারকে নিজের বাবা-মা দেখিয়ে এনআইডি গ্রহণ করেন।
পরবর্তীতে সেই এনআইডি ব্যবহার করে পরিবেশ অধিদপ্তরের আউটসোর্সিং কর্মী হিসেবে নিয়োগ পান আজিজ। বর্তমানে তিনি সেন্টমার্টিন বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটিতেও কর্মরত। শুধু তাই নয়, সড়ক নির্মাণ প্রকল্পে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থেকে চাঁদা দাবির অভিযোগও উঠেছে তার বিরুদ্ধে।
জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, আজিজ একসঙ্গে দুই প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন—যা চাকরির বিধি অনুযায়ী অবৈধ।
ভুয়া এনআইডির পেছনে স্থানীয় সহযোগিতা
তদন্তে জানা যায়, আজিজকে এনআইডি তৈরিতে সহযোগিতা করেছিলেন সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য আব্দুর রউফ। তবে তিনি অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, “কীভাবে আজিজ এনআইডি করেছে, তা আমি জানি না। আমি কোনো সহযোগিতা করিনি। হয়তো টাকা দিয়ে দালালদের মাধ্যমে এনআইডি করেছে।”
স্থানীয়দের বরাত দিয়ে জানা যায়, আজিজ মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিক মো. আব্দুলের ছেলে। ১৯৯২ সালে তার বাবা-মা বাংলাদেশে আশ্রয় নেন। পরের বছর তার বাবা মারা গেলে মা নুর নাহার ২০০১ সালে স্থানীয় বাসিন্দা আলী আহমদকে বিয়ে করেন। এরপর ২০১৭ সালে আলী আহমদ ও নুর নাহারকে নিজের পিতা-মাতা দেখিয়ে জন্মনিবন্ধন ও এনআইডি তৈরি করেন আজিজ। এনআইডিতে জন্ম তারিখ উল্লেখ করা হয় ১৯৯২ সালের ১ জানুয়ারি—যে বছর তার পরিবার বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল।
এ বিষয়ে আলী আহমদ বলেন, “আজিজের বাবা আব্দুল মারা যাওয়ার এক বছর পর আমি তার মা নুর নাহারকে বিয়ে করি। আজিজ আমার ছেলে নয়, সে মিয়ানমারের নাগরিক আব্দুলের ছেলে। দালাল চক্রের সহায়তায় আমাকে বাবা বানিয়ে এনআইডি করেছে বলে শুনেছি।”
সরকারি কর্মচারীর ভুয়া পরিচয়
স্থানীয় বাসিন্দা মোহাম্মদ হাসেম অভিযোগ করে বলেন, “আজিজ রোহিঙ্গা নাগরিক। কিন্তু স্থানীয় প্রভাবশালীদের আশ্রয়ে এনআইডি বানিয়ে এখন সরকারি চাকরি করছে।”
পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, সেন্টমার্টিনে বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির কর্মীর পাশাপাশি মেরিন পার্কে আউটসোর্সিং কর্মী হিসেবে নিয়োগ পান আজিজ। চাকরির বিধি ভঙ্গের কারণে ২০২২ সালের শেষের দিকে তাকে সাময়িকভাবে বরখাস্তও করা হয়েছিল। পরে তিনি পুনরায় দায়িত্বে যোগ দেন এবং অল্প সময়ের মধ্যেই আবার পরিবেশ অধিদপ্তরের কাজে যুক্ত হন।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছে চাঁদা দাবি
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় গত ৫ সেপ্টেম্বর থেকে গলাচিপা থেকে দক্ষিণপাড়া পর্যন্ত দুই কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ কাজ পায় এফএক্স নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। সম্প্রতি ওই প্রকল্পে কাজ চলাকালে পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মী পরিচয়ে ঠিকাদারদের কাছে ‘সিমেন্ট-তেলসহ উপকরণ’ দাবি করেন আজিজ।
এফএক্স প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক বসন্ত দে বলেন, “কয়েকদিন আগে আজিজ এসে বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে সমস্যা করা হবে না, তবে সিমেন্ট, তেল ও ১০০ বস্তা বালু দিতে হবে। কাজ শেষে দেওয়ার আশ্বাস দিলে তিনি লোক নিয়ে এসে ঝামেলা করার চেষ্টা করেন।”
প্রশাসনের অবস্থান
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে আব্দুল আজিজ বলেন, “আমি কারও কাছ থেকে চাঁদা দাবি করিনি। সঠিক তথ্য দিয়েই এনআইডি বানিয়েছি। একটি চক্র আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। তবে আলী আহমদ আমার প্রকৃত বাবা নন, এটা সত্য।”
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ এহসান উদ্দিন বলেন, “ভুল তথ্য দিয়ে এনআইডি তৈরি করা অপরাধ। চাঁদা দাবির অভিযোগও তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক খন্দকার মাহমুদ পাশা বলেন, “আব্দুল আজিজ আমাদের দপ্তরে চুক্তিভিত্তিক কর্মী। তিনি রোহিঙ্গা যুবক—এমন অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে।”
অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. শাহিদুল আলম বলেন, “আব্দুল আজিজের বিরুদ্ধে চাঁদা দাবির অভিযোগের পাশাপাশি রোহিঙ্গা পরিচয়ের তথ্যও এসেছে। তদন্ত শেষে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”