জুলাই আন্দোলন দমনে ব্যবহার হয় ৩ লাখ ৫ হাজারের বেশি রাউন্ড গুলি


জুলাই আন্দোলন দমনে ব্যবহার হয় ৩ লাখ ৫ হাজারের বেশি রাউন্ড গুলি

জুলাই আন্দোলন দমনকালে ব্যাপক পরিমাণ গুলির ব্যবহারসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্তে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও দুই নেতার বিরুদ্ধে করা মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ দ্বিতীয় দিনে প্রবাহিত হয়েছে। বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বে গঠিত তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-১ সোমবার এই মামলার ৫৪তম সাক্ষী হিসেবে তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীরের জবানবন্দি গ্রহণ করেছে। সাক্ষ্যগ্রহণ আগামীকাল মঙ্গলবারও চলবে।

তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীর জানান, “সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার তদন্ত চলাকালীন চলতি বছরের ২৫ জানুয়ারি পুলিশের সদর দফতর থেকে একটি ২১৫ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন সংগ্রহ করা হয়, যেখানে জুলাই আন্দোলন দমনে ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্র ও গুলির বিশদ তথ্য রয়েছে।” প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধুমাত্র ঢাকায় এলএমজি, এসএমজি, চাইনিজ রাইফেল, শটগান, রিভলবার ও পিস্তলসহ বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করে ৯৫ হাজার ৩১৩ রাউন্ড গুলি নিক্ষেপ করা হয়েছিল। দেশের অন্যান্য জায়গায় মিলিয়ে মোট গুলির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৫ হাজার ৩১১ রাউন্ড। এছাড়া র‌্যাব সদরদফতর থেকে হেলিকপ্টার ব্যবহারের বিষয়েও একটি প্রতিবেদন জব্দ করা হয়েছে।

জবানবন্দিতে তিনি আরও উল্লেখ করেন, জুলাই শহীদ ও জুলাই যোদ্ধাদের তালিকা সম্পর্কিত সরকারি গেজেটসহ বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক, টেলিভিশন সংবাদ এবং ভিডিও ক্লিপ জব্দ করা হয়েছে। এছাড়া জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অধিকারসহ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদন ও আন্দোলনের ওপর প্রকাশিত বই-গ্রন্থও তদন্তের জন্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এসব তথ্য বিটিভিতে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।

তিনি জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন সংগ্রহ করে হত্যাকাণ্ড, জখম ও নির্যাতনের তথ্য জব্দ করা হয়েছে। জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান হাসপাতাল, জাতীয় অর্থপ্রেডিক হাসপাতাল এবং জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউট থেকেও আহতদের চিকিৎসা সনদ সংগ্রহ করা হয়েছে। এছাড়া আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম থেকে ৮১ জন অজ্ঞাত পরিচয় নিহতের সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন জব্দ করা হয়েছে।

তদন্তের সময় জব্দকৃত আলামত ও তথ্যসমূহের মধ্যে রয়েছে ভিডিও ফুটেজ, অডিও ক্লিপ, বই-পুস্তক, বিশেষজ্ঞ রিপোর্ট, শহীদ পরিবারের সদস্য, আহত ও প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীদের জবানবন্দি, আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের স্বীকারোক্তি এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক তথ্যাদি। তিনি বলেন, “ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও আইজিপি মামুন গত বছরের ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সারাদেশে শান্তিপূর্ণ ছাত্র-জনতার ওপর প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার এবং আন্দোলন দমনে নির্দেশনা প্রদান করেন। এর ফলে দেড় হাজারের বেশি মানুষ নিহত, হাজার হাজার আহত ও নির্যাতিত হয়েছেন। আসামিরা হত্যাকাণ্ড, অপহরণ, মিথ্যা মামলা, যৌন নিপীড়নসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেছেন।”

একই দিনে ভিডিও প্রদর্শনীর মাধ্যমে হেলিকপ্টার থেকে বিনা উস্কানিতে গুলি চালানোর দৃশ্য, আহত ও নিহত ছাত্র-জনতার হাসপাতালে নেওয়ার মুহূর্ত, স্বজনদের আহাজারি এবং মর্গে পড়ে থাকা লাশের চিত্র দেখানো হয়। এছাড়া মামলার একজন ভুক্তভোগী ও সাক্ষী খোকন চন্দ্র বর্মনের গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তায় ছটফট করার ভিডিওও প্রদর্শিত হয়। গত বছরের ৫ আগস্ট যাত্রাবাড়ী থানার সামনে নিরাপদ ও অসংরক্ষিত অসংখ্য ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশের গুলি ও গ্রেনেড হামলার দৃশ্য প্রত্যক্ষ করা যায়।

প্রসিকিউটর তানভীর হাসান জোহা সাংবাদিকদের বলেন, “জুলাই আন্দোলনের সময় এনটিএমসির বহু কল রেকর্ড, সিসি ক্যামেরার ফুটেজ এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণাদি ধ্বংস করা হয়েছে। এসব কাজ করা হয়েছে এনটিএমসির সাবেক ডিজির নির্দেশে। বর্তমানে ডিজিটাল প্রমাণ উদ্ধারে কাজ চলছে।”

একই ট্রাইব্যুনালের অন্য মামলায়, কুষ্টিয়ায় জুলাই আন্দোলনের সময় ছয়জনের হত্যা মামলায় জাসদ সভাপতি ও সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের শুনানি আগামী ১৪ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হবে। বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত ট্রাইব্যুনাল-২ সোমবার এ দিন ধার্য করে।

প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন গাজী এমএইচ তামিম, আর আসামিপক্ষের পক্ষে ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী নাজনীন নাহার। প্রসিকিউশন এক সপ্তাহ সময় চান, আর আসামিপক্ষ দুই দিনের সময় বাড়ানোর আবেদন করেন। শুনানি শেষে ১৪ অক্টোবর দিন ধার্য করা হয়।

আগে গত ২৫ সেপ্টেম্বর ইনুর বিরুদ্ধে গণহত্যার মামলায় আটটি অভিযোগ দাখিল করা হয়, যার মধ্যে রয়েছে ষড়যন্ত্র, হত্যার নির্দেশ ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার। মামলায় অভিযোগ রয়েছে যে, গত বছরের ৫ আগস্ট কুষ্টিয়ায় ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচির সময় স্থানীয় আওয়ামী লীগ ক্যাডাররা পুলিশের উপস্থিতিতে নিরীহ আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালায়, যার ফলে ছয়জন নিহত হন। ইনু পরে রাজধানীর উত্তরা থেকে গ্রেপ্তার হন এবং বর্তমানে বিভিন্ন মামলায় কারাগারে রয়েছেন।

ঢাকাওয়াচ২৪ডটকমে লিখতে পারেন আপনিও ফিচার, তথ্যপ্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, ভ্রমণ ও কৃষি বিষয়ে। আপনার তোলা ছবিও পাঠাতে পারেন [email protected] ঠিকানায়।
×