গোপালগঞ্জে এনসিপি সমাবেশকে ঘিরে ‘গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন’ দেখছে আসক
- নিউজ ডেস্ক
- প্রকাশঃ ০৮:২৯ পিএম, ২৫ জুলাই ২০২৫

গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) এক রাজনৈতিক কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, প্রাণহানি ও পুলিশি অভিযানের ঘটনায় ‘গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের’ অভিযোগ তুলেছে বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)।
সংস্থাটির দাবি, গত ১৬ জুলাই গোপালগঞ্জে সংঘটিত ওই ঘটনার পর ২১ ও ২২ জুলাই চার সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল现场 তদন্ত করে যে তথ্য সংগ্রহ করেছে, তার ভিত্তিতে তৈরি প্রতিবেদনেই এই পর্যবেক্ষণ উঠে এসেছে। আসক তাদের পর্যবেক্ষণ শুক্রবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে প্রকাশ করে।
সংঘর্ষের পেছনে রাজনৈতিক উত্তেজনা
প্রতিবেদনে বলা হয়, এনসিপির পূর্বঘোষিত রাজনৈতিক সভাকে কেন্দ্র করে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের আক্রমণের শিকার হন এনসিপির নেতাকর্মীরা। ওই সহিংসতায় এ পর্যন্ত পাঁচজন নিহত এবং বহু মানুষ আহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে অনেকেই সাধারণ নাগরিক।
সমাবেশে উপস্থিত ব্যক্তিদের বর্ণনা অনুযায়ী, সকাল সাড়ে ১০টার দিকে প্রায় ৫০-৬০ জন ব্যক্তি ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে দিতে সমাবেশস্থলে হামলা চালায় এবং সেখানে সাজানো চেয়ার ভাঙচুর করে। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠলে এক থেকে দেড়শ সমর্থক ঘটনাস্থল ত্যাগ করে ডিসি অফিসের দিকে চলে যান।
পরবর্তীতে এনসিপির কর্মীরা পুনরায় সংগঠিত হয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় হামলাকারীদের ধাওয়া দেয়, যার ফলে তারা এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। এরপর সমাবেশস্থলের নিরাপত্তায় মোতায়েন করা হয় পুলিশ ও সেনাবাহিনী।
দুপুর ১টার পর এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরাপত্তায় সমাবেশস্থলে উপস্থিত হন এবং বক্তব্য শেষে গাড়িতে ওঠার সময় বিভিন্ন জায়গায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর ইট-পাটকেল নিক্ষেপ শুরু হয়, যা থেকে শহরজুড়ে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে।
হতাহতের বিবরণ
আসক জানায়, সংঘর্ষ চলাকালে পুলিশের টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড ও গুলিবর্ষণে চারজন ঘটনাস্থলে মারা যান। পরে ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান আরেকজন।
নিহতরা হলেন—দীপ্ত সাহা (২৫), রমজান কাজী (১৮), ইমন তালুকদার (১৭), সোহেল মোল্লা (৩২) এবং পরবর্তীতে মৃত্যু হওয়া রমজান মুন্সী। আসকের তথ্য অনুসারে, নিহতদের মধ্যে কেউ কেউ কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না।
নিহত ইমন তালুকদারের পরিবারের সদস্যরা দাবি করেন, একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে যাতে দেখা যায়, এক তরুণকে সেনাবাহিনীর সদস্যরা রাস্তায় ফেলে মুখে বুট দিয়ে আঘাত করছে। পরিবার বলছে, ভিডিওতে থাকা সেই তরুণই ইমন, যিনি গোপালগঞ্জের একটি ক্রোকারিজ দোকানে কর্মরত ছিলেন।
বিচারবহির্ভূত দাফনের অভিযোগ
নিহতদের পরিবার জানায়, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের চাপের মুখে তাদের মরদেহ ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফন বা সৎকার করতে বাধ্য করা হয়। পরে গণমাধ্যমে বিষয়টি উঠে এলে প্রশাসন তিনটি মরদেহ কবর থেকে উত্তোলন করে ময়নাতদন্ত করে। এ সময় আসকের প্রতিনিধিরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। পরিবারগুলো এ প্রক্রিয়াকে নতুন এক ধরনের হয়রানি হিসেবে বর্ণনা করেছে।
আহতদের অভিজ্ঞতা
আসকের প্রতিনিধিরা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন গুলিবিদ্ধদের সঙ্গে কথা বলেন। তাদের মধ্যে একজন জানান, তিনি রিকশায় কর্মস্থলে যাওয়ার পথে গুলিবিদ্ধ হন এবং তার এক হাতের আঙুল বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তিনি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন বলেও জানান।
শিশুসহ গণগ্রেপ্তারের অভিযোগ
আসক জানিয়েছে, ২১ জুলাই পর্যন্ত সংঘর্ষ সংক্রান্ত মামলায় ১৮ জন শিশুকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে, যাদের অনেকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে অভিযুক্ত। তবে পরিবারের দাবি, তাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
একই দিন পর্যন্ত দায়ের হওয়া আটটি মামলার মধ্যে ছয়টির কপি আসকের হাতে এসেছে। এতে দেখা যায়, মামলাগুলোতে ৫৪০০ জনকে আসামি করা হয়েছে, যার মধ্যে ৩৫৮ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। নামীয় আসামিদের মধ্যে রয়েছেন তিনজন নারী ও ৩২ জন সংখ্যালঘু হিন্দু।
ব্যবসা-বাণিজ্যে বাধা ও গ্রেপ্তারের ভয়
তদন্তে উঠে এসেছে, সমাবেশের আগের দিন স্থানীয় প্রশাসন সমাবেশস্থলের আশেপাশের দোকান বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়। অনেক দোকানদার দাবি করেছেন, প্রশাসনের লোকজন জোর করে দোকান বন্ধ করে দেয় এবং কোথাও কোথাও দোকানের ভেতরে মানুষ আটকে রাখে।
এছাড়া সহিংসতা না হওয়া এলাকাগুলোতেও গ্রেপ্তার ও হয়রানির অভিযোগ পাওয়া গেছে। আতঙ্কে অনেকেই ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে থাকতে বাধ্য হয়েছেন।
কারাগারে হামলা ও বন্দি স্থানান্তর
আসকের প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৬ জুলাই বিকালে একটি উচ্ছৃঙ্খল জনতা গোপালগঞ্জ জেলা কারাগারে হামলা চালিয়ে প্রাচীর ভাঙচুর করে এবং অস্ত্রাগারে ঢোকার চেষ্টা করে। কারা কর্তৃপক্ষ জানায়, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কারা পুলিশ ৮০ রাউন্ড মিসফায়ার করে এবং পরে সেনাবাহিনী এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
বন্দির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় গোপালগঞ্জ কারাগার থেকে ১০০ বন্দিকে পিরোজপুর এবং ৫০ জনকে বাগেরহাট কারাগারে স্থানান্তর করা হয়েছে। ১৮ জন শিশুকে যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয়।
সেনা বাহিনীর বক্তব্য পাওয়া যায়নি
আসকের প্রতিনিধিরা সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও সাক্ষাৎ করতে পারেননি। ২২ জুলাই ক্যাপ্টেন সাকিব নামের এক কর্মকর্তা জানান, তিনি ভিআইপি ডিউটিতে থাকায় কথা বলা সম্ভব নয়। পরবর্তী সময়ে ফোনেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
প্রশাসনের ভাষ্য
গোপালগঞ্জের পুলিশ সুপার বলেন, “১৬ জুলাই সমাবেশকে কেন্দ্র করে যে সহিংসতা হয়েছে, তা এক কথায় তীব্র। পুলিশ কোনো মারণাস্ত্র ব্যবহার করে নাই বরং সর্বোচ্চ ধৈর্য্য ধারণ করেছে।” তিনি জানান, ২০ জুলাই পর্যন্ত ১৭৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যাদের মধ্যে কেউ কেউ ৫৪ ধারায় আটক রয়েছেন।
তিনি আরও জানান, এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতাদের নিরাপত্তার জন্য সেনাবাহিনীর দুটি এপিসি তার অফিসে মোতায়েন করা হয়।
আসকের দাবি
আসক বলছে, “গোপালগঞ্জে সংঘটিত সহিংসতার ঘটনায় গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে। এছাড়া রাজনৈতিক সমাবেশে হামলার ঘটনা নাগরিকের সভা সমাবেশের অধিকারকে ক্ষুণ্ন করেছে।” সংস্থাটি এই ঘটনার নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ তদন্ত দাবি করেছে।
এনসিপির সভায় বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে কিছু আক্রমণাত্মক মন্তব্যের পরই পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে বলে আসক জানিয়েছে। তবে তারা মনে করে, সহিংসতা ও নিরাপরাধ মানুষের মৃত্যুর ঘটনার কোনো ন্যায্যতা নেই।
সংঘর্ষে নিহত ও আহতদের পরিবার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি করেছেন।