অনিয়ম, লুটপাট ও অব্যবস্থাপনায় ডুবে থাকা ৯ আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হচ্ছে


অনিয়ম, লুটপাট ও অব্যবস্থাপনায় ডুবে থাকা ৯ আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হচ্ছে

অনিয়ম, লুটপাট ও অব্যবস্থাপনায় ডুবে থাকা ৯টি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) বন্ধের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব প্রতিষ্ঠান আমানতকারীর টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ, তাদের ঋণের অধিকাংশই খেলাপি, এবং মূলধনে রয়েছে বিশাল ঘাটতি। এসব সূচকের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠানগুলোকে ‘অব্যবহারযোগ্য’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

২১ আগস্ট বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সভাপতিত্বে জরুরি বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‌‘ফাইন্যান্স কোম্পানি আইন ২০২৩’ অনুযায়ী তাদের লাইসেন্স বাতিল করে অবসায়নের প্রক্রিয়া শুরু করেছে।

বন্ধের সিদ্ধান্তপ্রাপ্ত ৯টি প্রতিষ্ঠান হলো: পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, আভিভা ফাইন্যান্স, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, ফারইস্ট ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি), প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স, জিএসপি ফাইন্যান্স কোম্পানি এবং প্রাইম ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড।

বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধে প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ক্ষুদ্র আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেওয়াকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি কর্মরত কর্মীরা চাকরিবিধি অনুযায়ী সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাবেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যালোচনায় উঠে এসেছে ভয়াবহ আর্থিক চিত্র। উদাহরণস্বরূপ:

  • এফএএস ফাইন্যান্স: মোট ঋণের ৯৯.৯৩% খেলাপি, লোকসান ১,৭১৯ কোটি টাকা।

  • ফারইস্ট ফাইন্যান্স: ৯৮% ঋণ খেলাপি, লোকসান ১,০১৭ কোটি টাকা।

  • বিআইএফসি: ৯৭.৩০% খেলাপি, লোকসান ১,৪৮০ কোটি টাকা।

  • ইন্টারন্যাশনাল লিজিং: খেলাপি ৩,৯৭৫ কোটি টাকা (৯৬%), লোকসান ৪,২১৯ কোটি টাকা।

  • পিপলস লিজিং: ৯৫% ঋণ খেলাপি, লোকসান ৪,৬২৮ কোটি টাকা।

  • আভিভা ফাইন্যান্স: ৮৩% খেলাপি, লোকসান ৩,৮০৩ কোটি টাকা।

২০২৩ সালে প্রণীত ‘ফাইন্যান্স কোম্পানি আইন’-এর ৭(১) ধারায় বলা আছে, আমানতকারীর স্বার্থপরিপন্থী কর্মকাণ্ড, দায় পরিশোধে সম্পদের অপর্যাপ্ততা ও মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থ হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে কোনো সময় লাইসেন্স বাতিল করতে পারে। ৭(২) ধারায় বলা আছে, লাইসেন্স বাতিলের আগে ১৫ দিনের মধ্যে কারণ দর্শানোর সুযোগ দিতে হবে। গত ২২ মে এসব প্রতিষ্ঠানকে সেই নোটিশ দেওয়া হয়। তবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সন্তোষজনক জবাব না পাওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক অবসায়নের সিদ্ধান্ত নেয়।

বর্তমানে দেশে মোট ৩৫টি এনবিএফআই রয়েছে। এর মধ্যে ২০টি প্রতিষ্ঠান সমস্যাগ্রস্ত। তাদের মোট ঋণের পরিমাণ ২৫,৮০৮ কোটি টাকা, যার ২১,৪৬২ কোটি টাকাই খেলাপি (৮৩.১৬%)। বিপরীতে বন্ধকি সম্পদের মূল্য মাত্র ৬,৮৯৯ কোটি টাকা—মোট ঋণের মাত্র ২৬%।

অন্যদিকে, তুলনামূলকভাবে ভালো অবস্থানে থাকা ১৫টি এনবিএফআইয়ের খেলাপি ঋণের হার মাত্র ৭.৩১%। এরা গত বছর ১,৪৬৫ কোটি টাকা মুনাফা করেছে এবং ৬,১৮৯ কোটি টাকা মূলধন উদ্বৃত্ত রয়েছে।

সার্বিকভাবে, আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে মোট আমানতের পরিমাণ ৪৮,৯৬৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে সমস্যাগ্রস্ত ২০টি প্রতিষ্ঠানের আমানত ২২,১২৭ কোটি টাকা এবং তাদের কাছে অন্যান্য ব্যাংক ও এনবিএফআইয়ের পাওনা আরও ৫,১৬৪ কোটি টাকা। গ্রাহকদের নিট ব্যক্তি আমানতের পরিমাণ প্রায় ৪,৯৭১ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করে, অবসায়নের প্রাথমিক ধাপে এই অর্থ ফেরত দেওয়া জরুরি। কর্মচারীদেরও চাকরিবিধি অনুযায়ী সকল প্রাপ্য সুবিধা দেওয়া হবে।

ঢাকাওয়াচ২৪ডটকমে লিখতে পারেন আপনিও ফিচার, তথ্যপ্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, ভ্রমণ ও কৃষি বিষয়ে। আপনার তোলা ছবিও পাঠাতে পারেন [email protected] ঠিকানায়।
×