
আগামী জাতীয় নির্বাচনে প্রচারণার ধরনে বড় পরিবর্তন এনেছে নির্বাচন কমিশন। ‘রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা, ২০২৫’-এ প্রথমবারের মতো ভোটের প্রচারে পোস্টার ও ড্রোন ব্যবহারে সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। একই সঙ্গে বিদেশে কোনো ধরনের প্রচারণা চালানোও নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
সোমবার গেজেট আকারে প্রকাশিত এই নতুন আচরণবিধিতে বলা হয়েছে, একজন প্রার্থী তার আসনে সর্বোচ্চ ২০টি বিলবোর্ড ব্যবহার করতে পারবেন, যার দৈর্ঘ্য ১৬ ফুট ও প্রস্থ ৯ ফুটের বেশি নয়। এছাড়া প্রার্থীদের একমঞ্চে ইশতেহার ঘোষণা এবং আচরণবিধি মেনে চলার অঙ্গীকারনামা দেওয়াও বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার কমিশনের পরামর্শ ও ২০০৮ সালের আচরণবিধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নতুন এই বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। এর আগে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন অধ্যাদেশ জারি করে ইসি।
আচরণবিধি অনুযায়ী, বিধি লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদণ্ড বা এক লাখ পঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানা হতে পারে। দলগুলোর ক্ষেত্রেও সমপরিমাণ অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। গুরুতর অপরাধে তদন্তের পর প্রার্থিতা বাতিল করার ক্ষমতাও ইসির হাতে থাকবে।
নতুন বিধিমালায় অনলাইন ও সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারণার ক্ষেত্রেও কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রার্থী বা তার এজেন্ট প্রচারণা শুরুর আগে ব্যবহৃত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নাম, অ্যাকাউন্ট আইডি ও ইমেইল ঠিকানা রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে জমা দিতে হবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই ব্যবহার করে মিথ্যা, বিভ্রান্তিকর বা ঘৃণাত্মক কনটেন্ট তৈরি ও প্রচার নিষিদ্ধ। বিধিমালায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, “ঘৃণাত্মক বক্তব্য, ভুল তথ্য, কারো চেহারা বিকৃত করা ও নির্বাচন সংক্রান্ত বানোয়াট তথ্যসহ সকল প্রকার ক্ষতিকর কনটেন্ট বানানো ও প্রচার করা যাবে না।”
নির্বাচনি প্রচারণায় ধর্মীয় বা জাতিগত অনুভূতির অপব্যবহার, প্রতিপক্ষ বা সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে উসকানিমূলক ভাষা ব্যবহার এবং চরিত্র হননমূলক প্রচারণা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনো তথ্য প্রকাশ বা শেয়ার করার আগে তার সত্যতা যাচাইয়ের নির্দেশও দেওয়া হয়েছে।
এবারের আচরণবিধিতে বিদেশে জনসভা, পথসভা বা কোনো ধরনের নির্বাচনি সমাবেশ আয়োজনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। নির্বাচনের দিন ও প্রচারের সময় ড্রোন বা কোয়াডকপ্টার ব্যবহার করা যাবে না। ব্যানার, ফেস্টুন ও লিফলেটে পলিথিন বা পিভিসি উপকরণ ব্যবহার নিষিদ্ধ এবং পরিবেশবান্ধব সামগ্রী ব্যবহারে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
আচরণবিধিতে শব্দের মাত্রা ৬০ ডেসিবেলের মধ্যে রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিদ্যুতের ব্যবহার শুধুমাত্র ডিজিটাল বিলবোর্ডে সীমিত থাকবে, অন্য কোথাও আলোকসজ্জা করা যাবে না। ভোটার স্লিপ বিতরণের সময় প্রার্থীর নাম, ছবি বা প্রতীক ব্যবহার করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
এবারের বিধিমালায় অন্তর্বর্তীকালীন বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টাদের ‘অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, ফলে তারা কোনো প্রার্থীর হয়ে প্রচারে অংশ নিতে পারবেন না।
প্রার্থীদের জন্য নতুনভাবে যুক্ত হয়েছে একমঞ্চে ইশতেহার ঘোষণার সুযোগ। রিটার্নিং কর্মকর্তার উদ্যোগে একই দিনে সব প্রার্থী নিজেদের ঘোষণাপত্র পাঠ করতে পারবেন।
নতুন বিধিমালায় প্রথমবারের মতো আইটি-নির্ভর ডাক ভোট বা পোস্টাল ভোটিং চালুর ঘোষণা এসেছে। এবার দেশি-বিদেশি তিন শ্রেণির ভোটার ডাকযোগে ভোট দিতে পারবেন।
এই আচরণবিধি ও আরপিও সংশোধনের মাধ্যমে নির্বাচনি আইনের সামগ্রিক সংস্কার কাজ সম্পন্ন করেছে নির্বাচন কমিশন। এরই মধ্যে ভোটার তালিকা আইন, নির্বাচন কর্মকর্তা বিশেষ বিধান আইন, ইসি সচিবালয় আইন, ভোটকেন্দ্র নীতিমালা, দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষণ নীতিমালা এবং সাংবাদিক নীতিমালা সংশোধন শেষ হয়েছে বলে কমিশন জানিয়েছে।