
ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদিকে গুলি করে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় তদন্তে নতুন অগ্রগতির কথা জানিয়েছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। সন্দেহভাজন ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে দাউদ খান এবং তার মালিকানাধীন আইটি প্রতিষ্ঠান ‘অ্যাপল সফট আইটি লিমিটেড’-এর কম্পিউটার জব্দ করা হয়েছে। পাশাপাশি তার পরিবারের একজন সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক সূত্র জানায়, হাদিকে গুলির ঘটনায় অভিযুক্ত ফয়সালের সঙ্গে একটি বড় ইসলামী দলের কয়েকজন নেতার সম্পৃক্ততার তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দারা। হামলার পর ফয়সাল মোটরসাইকেলে প্রথমে সাভার, পরে ধামরাই যান। সেখান থেকে অন্য একটি গাড়িতে করে তিনি শেরপুরের নালিতাবাড়ী এলাকায় পৌঁছান এবং পরে সীমান্তের দিকে অগ্রসর হন। তিনি সীমান্ত পার হয়ে ভারতে পালিয়েছেন নাকি দেশে আত্মগোপনে আছেন—তা যাচাই করছে গোয়েন্দা ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।
এ ঘটনায় নালিতাবাড়ী সীমান্ত এলাকা থেকে সিববিয়ন ও সঞ্জয় নামে দুই ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি, তারা সীমান্ত দিয়ে অবৈধ লোক পারাপারের সঙ্গে জড়িত।
ফয়সাল করিমের মালিকানাধীন ‘অ্যাপল সফট আইটি লিমিটেড’ একটি ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন, মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন ও সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টভিত্তিক প্রতিষ্ঠান, যা ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়া ২০১৬ সালে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) এবং সরকারের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘ব্যাটল অব ৭১’ নামে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একটি কম্পিউটার গেম তৈরি করেছিল ওয়াইসিইউ টেকনোলজি লিমিটেড। ওই প্রতিষ্ঠানের মালিকও ফয়সাল করিম মাসুদ।
জানা গেছে, ফয়সাল করিম মাসুদ কার্যক্রমনিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ২০১৯ সালের ১১ মে ঘোষিত কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে তিনি সদস্য ছিলেন। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরদিন শুক্রবার দুপুরে রাজধানীর পুরানা পল্টনের বক্স কালভার্ট রোডে গুলিবিদ্ধ হন ওসমান হাদি। মোটরসাইকেলে আসা এক আততায়ী তাকে গুলি করে দ্রুত পালিয়ে যায়। বর্তমানে হাদি রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ওসমান হাদির প্রতিষ্ঠিত ইনকিলাব কালচারাল সেন্টারসহ বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সময়ে হাদির সঙ্গে ফয়সাল করিমের একাধিক ছবি পাওয়া গেছে। এসব ছবিতে থাকা ফয়সালের চেহারার সঙ্গে গুলিবর্ষণকারী ব্যক্তির মিল থাকায় তাকে প্রধান সন্দেহভাজন হিসেবে দেখা হচ্ছে।
এ ঘটনায় অভিযুক্তকে ধরিয়ে দিতে পারলে ৫০ লাখ টাকা পুরস্কারের ঘোষণা দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।
বিভিন্ন সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, ফয়সাল করিম ২০১৩ সালে ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার বিজ্ঞানে স্নাতক সম্পন্ন করেন এবং পরে আরেকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করেন। তার নাম আলোচনায় আসার পর আওয়ামী লীগ আমলে দুইবারের রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতার সঙ্গে তার ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। একই সঙ্গে ঢাকা-৮ আসনে হাদির গণসংযোগ এবং বাংলামোটরে অবস্থিত ইনকিলাব কালচারাল সেন্টারে হাদির সঙ্গে ফয়সালের উপস্থিতির ছবিও ভাইরাল হয়। এতে ধারণা করা হচ্ছে, ফয়সাল করিম দীর্ঘদিন ধরে হাদিকে অনুসরণ করছিলেন।
এছাড়া ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ গঠিত ‘আসনভিত্তিক নির্বাচন পরিচালনা ও সমন্বয়ক কমিটি’-তে ঢাকা-১২ আসনের সদস্য ছিলেন ফয়সাল করিম। ওই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর গত বছরের ২৮ অক্টোবর ঢাকার আদাবরের বাইতুল আমান হাউজিং সোসাইটি এলাকায় ব্রিটিশ কলাম্বিয়া স্কুলের চতুর্থ তলায় একটি অফিসে অস্ত্রের মুখে ১৭ লাখ টাকা লুটের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় আদাবর থানায় করা মামলায় প্রধান আসামি ছিলেন ফয়সাল করিম। মামলার কিছুদিন পর, ৭ নভেম্বর, র্যাব তাকে আদাবর এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে। তখন তার কাছ থেকে দুটি বিদেশি পিস্তল, দুটি ম্যাগাজিন, পাঁচটি গুলি, তিনটি মোবাইল ফোন এবং পাঁচ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়।