
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরদিনই রাজধানীর রাজনীতিতে নেমে আসে চাঞ্চল্য। ১২ ডিসেম্বর নির্বাচনি প্রচারণাকালে গুলিবিদ্ধ হন ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও ঢাকা-৮ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী শরিফ ওসমান হাদি। গুরুতর আহত অবস্থায় প্রথমে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেওয়া হয়। অস্ত্রোপচারের পর সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে এভারকেয়ার হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। দেশজুড়ে আলোচিত এই ঘটনার সন্দেহভাজন হিসেবে পুলিশ শনাক্ত করেছে ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে দাউদ খানকে।
ঘটনার পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে ছড়িয়ে পড়েছে গুলির মুহূর্তের সিসিটিভি ফুটেজ এবং নির্বাচনি প্রচারণায় ছদ্মবেশে অংশ নেওয়ার কিছু ছবি। এসব দৃশ্য বিশ্লেষণ করে ফয়সাল করিমকে সন্দেহভাজন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এতে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, কে এই ফয়সাল করিম এবং কী তার পরিচয়।
তথ্য অনুযায়ী, ফয়সাল করিম নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ২০১৯ সালের ১১ মে ঘোষিত কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে তিনি সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। পেশাজীবী নেটওয়ার্কিং সাইট লিংকডইনে ফয়সাল করিমের নামে থাকা একটি প্রোফাইল যে তারই, তা ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সাবেক এক নেতা নিশ্চিত করেছেন। ওই প্রোফাইলে তিনি নিজেকে অ্যাপল সফট আইটি, ওয়াইসিইউ টেকনোলজি এবং এনলিস্ট ওয়ার্ক নামের তিনটি প্রতিষ্ঠানের মালিক হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
লিংকডইনের তথ্য অনুযায়ী, ফয়সাল করিম ২০১৩ সালে ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার বিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। পরবর্তীতে আরেকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ সম্পন্ন করার কথাও সেখানে উল্লেখ রয়েছে।
২০১৬ সালে ফয়সাল করিমের মালিকানাধীন ওয়াইসিইউ টেকনোলজি লিমিটেড বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের সহযোগিতায় এবং সরকারের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘ব্যাটল অব ৭১’ নামে একটি কম্পিউটার গেম তৈরি করে। গেমটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয়। সে বছরের নভেম্বরে গেমটির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বেসিসের তৎকালীন সভাপতি এবং পরবর্তী সময়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার উপস্থিত ছিলেন।
২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ আসনভিত্তিক নির্বাচন পরিচালনা ও সমন্বয়ক কমিটি গঠন করে। ঢাকা-১২ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। ওই আসনের সমন্বয়ক কমিটির সদস্য হিসেবেও ফয়সাল করিমের নাম ছিল।
একটি সূত্র জানিয়েছে, ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় আন্দোলন দমনে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে মাঠে সক্রিয় ছিলেন ফয়সাল করিম।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর গত বছরের ২৮ অক্টোবর ঢাকার আদাবরের বাইতুল আমান হাউজিং সোসাইটি এলাকায় ব্রিটিশ কলাম্বিয়া স্কুলের চতুর্থ তলায় একটি অফিসে অস্ত্রের মুখে ১৭ লাখ টাকা লুটের ঘটনা ঘটে। ওই মামলায় প্রধান আসামি ছিলেন ফয়সাল করিম। পরে র্যাব তাকে গ্রেপ্তার করে। মামলাটিতে চলতি বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট থেকে তিনি জামিন পান। জামিনে থাকার সময়ই এবার তার বিরুদ্ধে ওসমান হাদিকে গুলি করার অভিযোগ সামনে এলো।
এই লুটের মামলায় দুটি অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হওয়া একজন ব্যক্তি মাত্র ৩ মাস ৮ দিনের মধ্যে কীভাবে জামিন পেলেন, তা নিয়েও নানা প্রশ্ন উঠেছে। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন মহলে চলছে তীব্র আলোচনা ও সমালোচনা।
এদিকে সন্দেহভাজন ফয়সাল করিম সম্পর্কে তথ্য পেলে তা জানাতে ঢাকা মহানগর পুলিশ সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। একই সঙ্গে ওসমান হাদিকে গুলি করা ব্যক্তিকে ধরিয়ে দিতে পারলে ৫০ লাখ টাকা পুরস্কারের ঘোষণা দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।
গুলির ঘটনার পর ফয়সাল করিমের নাম আলোচনায় আসতেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে তার সঙ্গে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতার সঙ্গে তোলা কিছু ছবি ছড়িয়ে পড়ে।
উল্লেখ্য, শুক্রবার ১২ ডিসেম্বর দুপুরে রাজধানীতে নির্বাচনি প্রচারণার সময় শরিফ ওসমান হাদি গুলিবিদ্ধ হন। ঘটনার পর তাকে দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেওয়া হয় এবং অস্ত্রোপচারের পর এভারকেয়ার হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।
প্রসঙ্গত, ওসমান হাদির প্রতিষ্ঠিত ইনকিলাব কালচারাল সেন্টারসহ বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সময়ে ফয়সাল করিমের সঙ্গে তার একাধিক ছবি রয়েছে। এসব ছবিতে থাকা ব্যক্তির সঙ্গে গুলিবর্ষণকারী সন্দেহভাজনের চেহারার মিল পাওয়ায় ফয়সাল করিমকে এই হামলার সঙ্গে যুক্ত বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। এ বিষয়ে ইতোমধ্যে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।