ইরানের হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটিতে হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে যারা

ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক বিমান হামলার প্রতিক্রিয়ায় মধ্যপ্রাচ্যে নতুন উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। এরই মধ্যে ইরান-সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটিগুলো লক্ষ্য করে পাল্টা হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানিয়েছে নিউইয়র্ক টাইমস। পত্রিকাটির প্রতিবেদনে বলা হয়, মার্কিন সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এরই মধ্যে ইরানপন্থি মিলিশিয়াদের সশস্ত্র প্রস্তুতি শনাক্ত করেছে। প্রাথমিকভাবে ইরাকের আইন আল আসাদ ঘাঁটি এবং সিরিয়ার কিছু মার্কিন অবস্থানে হামলা চালানো হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত হোয়াইট হাউস কিংবা তেহরান আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো মন্তব্য করেনি। তবে সূত্র জানিয়েছে, ইরাক সরকার সম্ভাব্য হামলা ঠেকাতে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। আপাতত এসব মিলিশিয়াদের নিয়ন্ত্রণে রাখা গেছে বলেও দাবি করা হয়। ইরাকের পশ্চিমাঞ্চলীয় আনবার প্রদেশে অবস্থিত আইন আল আসাদ ঘাঁটিটি যুক্তরাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটি। এখান থেকেই ইরাকি বাহিনী ও ন্যাটোর বিভিন্ন অভিযানে সহায়তা দেয় মার্কিন সেনারা। ২০২০ সালে ইরানের কুদস ফোর্সের প্রধান জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন হামলায় হত্যা করার পর এই ঘাঁটি লক্ষ্য করে ব্যাপক মিসাইল হামলা চালিয়েছিল ইরান। এ ছাড়া ইরাকের কুর্দিস্তান অঞ্চলের ইরবিল বিমানঘাঁটিতেও রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্র বাহিনীর উপস্থিতি। এই ঘাঁটি গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদান, প্রশিক্ষণ এবং সরবরাহ সহায়তার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়। উল্লেখ্য, ইরান-সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ইরাকের হাশদ আশ-শাবি, যার অন্তর্ভুক্ত কতাইব হিজবুল্লাহ, আসাইব আহল আল-হক ও বদর অর্গানাইজেশন যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী হামলায় সক্রিয়। লেবাননের হিজবুল্লাহ ইরানের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র, যারা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা সৌদি আরব ও ইসরায়েলের ওপর ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। সিরিয়ায় ইরান-সমর্থিত ফাতেমিয়ুন (আফগান যোদ্ধা) ও জাইনাবিয়ুন (পাকিস্তানি শিয়া) ব্রিগেড রয়েছে, যারা আসাদ সরকারের পক্ষে যুদ্ধ করে। এসব গোষ্ঠীকে সমন্বয়, অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করে ইরানের বিপ্লবী গার্ডের বৈদেশিক শাখা কুদস ফোর্স।

তিন দিকে মোড় নিতে পারে সংঘাত পরিস্থিতি

ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত পরিস্থিতি যে কোনো সময় নতুন দিকে মোড় নিতে পারে। এ ক্ষেত্রে তিনটি পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। ইরান হামলা বাড়িয়ে দিতে পারে অথবা রণে ভঙ্গ দেওয়ার কৌশল নিতে পারে এবং যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে সংঘাত থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারে। দ্য কনভারসেশনের বিশ্লেষণে এসব কথা বলা হয়েছে। রোববার ভোরে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ফর্দো, নাতাঞ্জ ও ইস্পাহান পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায়। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েল গাজায় যে হামলা শুরু করেছিল, এই হামলা সেই ধারাবাহিকতার অংশ। এর পর ইসরায়েল ধারাবাহিকভাবে ইরানসমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে দুর্বল করে ফেলার কৌশল নেয়। গাজায় হামাসকে দমানোর পর তারা লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহকে দুর্বল করে ফেলে। এর পর সিরিয়ায় হামলা করে ইরানকে পিছু হটাতে বাধ্য করে। ফলে সিরিয়ায় ইরানসমর্থিত আসাদ সরকারের পতন ঘটে। ইরান বরাবরই শক্তিশালী ভূমিকায় ছিল। ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাতেও দেশটি ব্যাপক শক্তি প্রদর্শন করে। এই অবস্থায় নেতানিয়াহু মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওপর ইরানে হামলার জন্য চাপ সৃষ্টি করেন। ট্রাম্প নেতানিয়াহুর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেই ৩০ হাজার পাউন্ডের বাঙ্কার বাস্টার বোমা হামলা চালান ইরানে। এই হামলার পর ট্রাম্পের কড়া সমালোচনা করেছেন বিশ্বনেতারা। বড় হামলার কৌশল নিতে পারে ইরান যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পরিপ্রেক্ষিতে ইরান নিজের শক্তি প্রদর্শনে ব্যাপক পরিসরে হামলা চালানোর নীতি গ্রহণ করতে পারে। যদিও তারা জানে, যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই করে টিকে থাকার শক্তি তাদের নেই। তার পরও ইরানি জনগণকে আশ্বস্ত করতে প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠতে পারে দেশটি। সর্বোচ্চ নেতা আলি খামেনির নীতি এটাই। এর আগেও একই নীতি গ্রহণ করেছিল ইরান। ২০২০ সালে যখন ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পসের প্রধান কাসেম সোলেইমানিকে হত্যা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র, তখনও প্রতিশোধ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল তেহরান। পরবর্তী সময়ে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে বড় হামলা হয়। কোনো মার্কিন সেনা নিহত না হলেও কৌশলে অবকাঠামো গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। এবারও একই কৌশল নিতে পারে ইরান। তবে এবার মার্কিন ঘাঁটি লক্ষ্যবস্তু নাও বানাতে পারে তারা। এ ক্ষেত্রে ইসরায়েলের ওপর ধারাবাহিক ও বড় হামলা অব্যাহত রাখতে পারে। আর এটা নির্ভর করবে তাদের হাতে কতগুলো ক্ষেপণাস্ত্র বা ড্রোন রয়েছে তার ওপর। কারণ, ইতোমধ্যে ৪০০টির বেশি ক্ষেপণাস্ত্র তারা ব্যবহার করে ফেলেছে। ফলে সমরাস্ত্রের মজুত কমে যাচ্ছে। রণে ভঙ্গ দিতে পারে তেহরান ইরানের সামনে সংঘাত থেকে পিছু হটার কৌশলও রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র হামলা করার আগে ইরান বারবার বলে আসছিল, ইসরায়েল হামলা বন্ধ করলে তারাও হামলা বন্ধ করে দেবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশটি আপসের পথ গ্রহণ করতে পারে। ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি ঘোষণা দিলে তারা আবারও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পারমাণবিক কর্মসূচিতে একটি চুক্তিতে পৌঁছাতে রাজি হতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে সমস্যা করবে ইসরায়েল। নেতানিয়াহু পরমাণু আলোচনা চালিয়ে যাওয়ায় বিশ্বাসী নন। ইসরায়েল পরমাণু কর্মসূচির সম্পূর্ণ ধ্বংস দাবি করে হামলা চালিয়ে যাওয়ার নীতি নিয়েছে। ফলে চতুর নেতানিয়াহু ইরানের জ্বালানি অবকাঠামোসহ বেসামরিক স্থাপনায় হামলা অব্যাহত রাখতে পারে। আশির দশকে ইরাকের সঙ্গে যুদ্ধের সময়ও ইরান রণে ভঙ্গ দিয়েছিল মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর। পরবর্তী সময়ে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে যুদ্ধবিরতিতে যায় তেহরান। চলমান সংঘাতের ক্ষেত্রেও দেশটি একই কৌশল নিতে পারে। খামেনি তাঁর শাসন ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে ও সমরাস্ত্র সক্ষমতার কথা বিবেচনা করে পিছু হটার কৌশল নিতে পারেন। সংঘাত থেকে বিরত থাকতে পারে যুক্তরাষ্ট্র চলমান সংঘাত থেকে যুক্তরাষ্ট্র যদি নিজেকে সরিয়ে নেয়, তাহলে যুদ্ধ পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। দ্য ইকোনমিস্টের সাম্প্রতিক জরিপে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ুক তা চায় না ট্রাম্পের রিপাবলিকান দলের ৫৩ শতাংশ সমর্থক। যুদ্ধের পক্ষে মাত্র ১৬ শতাংশের অবস্থান। এই অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের ইরানে হামলার বিষয়টি জনপ্রিয়তা পায়নি, তা স্পষ্ট। বরং আলোচনার মাধ্যমে সংঘাত বন্ধের পদক্ষেপ নিলে ট্রাম্পকে দেশটির জনগণ স্বাগত জানাতে প্রস্তুত। সংঘাতে ওয়াশিংটন যদি আরও জড়িয়ে পড়ে কিংবা মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন স্বার্থের ওপর হামলা হয়, তাহলে নাগরিকদের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হবে ট্রাম্প প্রশাসন। তাছাড়া ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পূর্ণ ধ্বংস হবে কিনা, তাও অজানা। দেশটি নতুন করে আগামীতে কর্মসূচি চালিয়ে নিতেও পারে। এই বিষয়টিও যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধ থেকে বিরত রাখতে পারে।

ইসরায়েলি হামলায় ইরানের নিহত বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৫০ জনে

ইরানে ইসরায়েলি হামলায় কমপক্ষে ৯৫০ জন নিহত এবং ৩,৪৫০ জন আহত হয়েছেন বলে সোমবার জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা হিউম্যান রাইটস অ্যাক্টিভিস্টস। সংস্থাটি জানায়, নিহতদের মধ্যে ৩৮০ জন বেসামরিক নাগরিক এবং ২৫৩ জন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য। ২০২২ সালে মাহসা আমিনির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ইরানজুড়ে ছড়িয়ে পড়া ব্যাপক বিক্ষোভের সময়, হতাহতের সুনির্দিষ্ট ও বিশদ তথ্য প্রকাশ করেছিল একটি আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক সংস্থা। ইরানের ভেতরের স্থানীয় সংবাদ ও প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এবং নিজেদের নির্ভরযোগ্য উৎসের সঙ্গে মিলিয়ে তথ্য যাচাই করে সংস্থাটি সঠিক চিত্র তুলে ধরে বিশ্ববাসীর সামনে। এ ধরনের নিরপেক্ষ তথ্য উপস্থাপন ইরানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণে ভূমিকা রাখে। এদিকে শনিবার ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, ইসরায়েলি হামলায় প্রায় ৪০০ ইরানি নিহত এবং ৩,০৫৬ জন আহত হয়েছেন। উল্লেখ্য, ইরান সরকার নিয়মিত হতাহতের সংখ্যা প্রকাশ করে না এবং পূর্বেও অনেক সময় হতাহতের সংখ্যা কমিয়ে দেখিয়েছে বলেও অনেক অভিযোগ রয়েছে। সূত্র: আরব নিউজ

ট্রাম্পের যে সিদ্ধান্তে ইরানের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন হলিউড তারকারা

ঘটনাটি ২০২০ সালের ৩ জানুয়ারির। সেদিন ইরাকের বাগদাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বাইরে ড্রোন হামলা চালিয়ে ইরানের প্রভাবশালী সামরিক নেতা, কুদস ফোর্সের প্রধান জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে হত্যা করে যুক্তরাষ্ট্র। এই অভিযানের নির্দেশ দেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ওই ঘটনার পর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তীব্র প্রতিক্রিয়ার পাশাপাশি বিষয়টি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরেও সমালোচনার ঝড় ওঠে। তখন হলিউডের বহু তারকাই প্রকাশ্যে ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন এবং ইরানের জনগণের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেন। মার্কিন অভিনেত্রী, সমাজকর্মী ও লেখিকা রোজ ম্যাকগাওয়ান সেই সময় একটি টুইটে লেখেন, ‘প্রিয় ইরান, যুক্তরাষ্ট্র আপনাদের দেশ, পতাকা ও জনগণের প্রতি অসম্মান দেখিয়েছে। আমাদের ৫২ শতাংশ জনগণ এ বিষয়ে বিনীতভাবে দুঃখ প্রকাশ করছে। আমরা আপনাদের সঙ্গে শান্তি চাই। আমরা একটি সন্ত্রাসী সরকারের কাছে জিম্মি। মুক্তির উপায় আমাদের জানা নেই। অনুগ্রহ করে আমাদের হত্যা করবেন না।’ তিনি টুইটের শেষে ‘সোলাইমানি’ হ্যাশট্যাগও যুক্ত করেন। সে সময় এই বক্তব্য ঘিরে রোজ ম্যাকগাওয়ানকে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। পরে আরেকটি টুইটে তিনি জানান, আসন্ন যুদ্ধের ভয়েই তিনি এমন মন্তব্য করেছেন। একই সময়ে, মার্কিন কৌতুক অভিনেত্রী ক্যাথলিন ম্যারি গ্রিফিনও এক টুইটে লেখেন, ‘ডোনাল্ড ট্রাম্প অত্যন্ত মূর্খ ও চিন্তাহীনভাবে যুদ্ধের ঘোষণা দিয়ে বিশ্বের যে কোনো স্থানে থাকা প্রত্যেক আমেরিকানকে মারাত্মক ঝুঁকির মুখে ফেলেছেন।’ তাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন মার্কিন প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা ও লেখক মাইকেল মুর। তিনি কড়া ভাষায় ট্রাম্পের সমালোচনা করে লেখেন, ‘আমাদের (আমেরিকানদের) অজান্তেই ইরানের সঙ্গে একটি অনাকাঙ্ক্ষিত যুদ্ধে জড়ানো হয়েছে।’ পাঁচ বছর পর এই টুইটগুলো আবারও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনায় এসেছে। কারণ রোববার (২২ জুন) ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এবারও যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে আছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ইরান বলছে, এটি তাদের সার্বভৌমত্বে সরাসরি হস্তক্ষেপ। আর বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ বাড়ছে নতুন করে এক বিপজ্জনক যুদ্ধের শঙ্কায়। তাই হলিউড তারকাদের সেই সমালোচনাগুলো এখন যেন ভবিষ্যদ্বাণীমূলক হয়ে উঠেছে এবং ট্রাম্পের নীতির ধারাবাহিকতায় মধ্যপ্রাচ্যে আবারও অস্থিরতার দানা বাঁধছে।

হন্যে হয়ে ইরানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্র

ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলার পর পরই দেশটির সঙ্গে পুনরায় কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন ও আলোচনার পরিবেশ তৈরিতে প্রকাশ্য ও গোপন দুই মাধ্যমেই বার্তা পাঠাচ্ছে ওয়াশিংটন। এমন তথ্য দিয়েছেন মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ। খবর সিএনএনের। রোববার (২২ জুন) পেন্টাগনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে হেগসেথ বলেন, আমি শুধু এটুকুই নিশ্চিত করতে পারি, প্রকাশ্য ও ব্যক্তিগত- উভয় মাধ্যমেই একাধিক চ্যানেলের মাধ্যমে ইরানকে বার্তা পাঠানো হচ্ছে, যাতে তারা আলোচনার টেবিলে আসার সর্বোচ্চ সুযোগ পায়। তিনি আরও বলেন, তারা (ইরানি কর্তৃপক্ষ) স্পষ্টভাবে জানে, যুক্তরাষ্ট্র কী চাইছে এবং শান্তির জন্য কী ধরনের পদক্ষেপ তাদের নেওয়া উচিত। আমরা আশাবাদী, তারা এই সুযোগ কাজে লাগাবে। সিএনএন জানায়, যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে চলতি বছরের এপ্রিল থেকে পাঁচ দফা পারমাণবিক আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এই আলোচনায় নেতৃত্ব দেন মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক মার্কিন বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ। তবে গত সপ্তাহে ইসরায়েলের নজিরবিহীন হামলার পর, ২২ জুন নির্ধারিত ষষ্ঠ দফার বৈঠক বাতিল করা হয়। এই অচলাবস্থা তৈরি হওয়ার পরই প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় বিমান হামলার সিদ্ধান্ত নেন বলে জানায় সিএনএন। বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র এখন ‘সংলাপ ও চাপের যুগপৎ কৌশল’ গ্রহণ করেছে। অর্থাৎ, একদিকে তারা ইরানকে কূটনীতির পথে টানার চেষ্টা করছে, অন্যদিকে সামরিক চাপ সৃষ্টি করে আলোচনায় সুবিধাজনক অবস্থানে যেতে চাইছে। ইরানের পক্ষ থেকে এখনো প্রকাশ্যে মার্কিন আহ্বানে সরাসরি সাড়া মেলেনি। তবে দেশটির ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সূত্রগুলো ইঙ্গিত দিয়েছে, শর্তহীন আলোচনা নয়, বরং আস্থার পরিবেশ তৈরিই এখন মুখ্য। তারা মনে করছে, কূটনৈতিক আলোচনায় ফেরার আগে যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বাসযোগ্য অবস্থান দেখাতে হবে এবং অতীতের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের ব্যাখ্যা দিতে হবে।

ইসরায়েলে প্রথমবারের মতো ‘খাইবার শেকান’ ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ল ইরান

ইসরায়েলের বিরুদ্ধে চলমান ‘অপারেশন ট্রু প্রমিজ-৩’ এর ২০তম ধাপে ইরান প্রথমবারের মতো তাদের মাল্টি-ওয়ারহেড সমৃদ্ধ ‘খাইবার শেকান’ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে। তৃতীয় প্রজন্মের এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ইসরায়েলের লক্ষবস্তুতে সফলভাবে আঘাত হেনেছে বলেও জানিয়েছে ইরান। খবর প্রেস টিভির। এক বিবৃতিতে ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড কোরের (আইআরজিসি) জনসংযোগ বিভাগ জানিয়েছে, ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় মার্কিন হামলা চালানোর পরপর প্রতিশোধ নিতে পাল্টা হামলায় ইসরায়েলে তৃতীয় প্রজন্মের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র খাইবার শেকান ব্যবহার করা হয়েছে। আইআরজিসি জানায়, রোববার (২২ জুন) সকালের ওই হামলায় ৪০টি কঠিন ও তরল জ্বালানির ক্ষেপণাস্ত্রগুলো লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে। আইআরজিসি আরও জানায়, এই অপারেশনে আইআরজিসির বিমান বাহিনী প্রথম বারের মতো মাল্টি ওয়ারহেড সমৃদ্ধ তৃতীয় প্রজন্মের খাইবার শেকান ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে। আশ্চর্যজনক কৌশলের মাধ্যমে এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ব্যাপক ধ্বংসাত্মক শক্তি নিয়ে নির্ভুলভাবে লক্ষ্যভেদ করেছে।

‘ইরানকে পরমাণু অস্ত্র দিতে প্রস্তুত বিভিন্ন দেশ’

ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হামলার পর কয়েকটি দেশ তেহরানকে সরাসরি পরমাণু অস্ত্র সরবরাহে প্রস্তুত রয়েছে বলে দাবি করেছেন রাশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং নিরাপত্তা কাউন্সিলের উপপ্রধান দিমিত্রি মেদভেদেভ। রোববার এক্স (সাবেক টুইটার)-এ দেওয়া পোস্টে তিনি এ মন্তব্য করেন। মেদভেদেভ বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ইসফাহান, নাটানজ ও ফোরদোতে যেসব স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে, তাতে যে লক্ষ্য অর্জনের কথা ট্রাম্প বলেছিলেন, বাস্তবে হয়েছে তার ঠিক উল্টো। এসব হামলার ফলে পারমাণবিক পদার্থ সমৃদ্ধকরণ এবং এখন বলা যেতেই পারে—ইরানের পরমাণু অস্ত্র উৎপাদনের পথ আরও সুগম হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, বেশ কয়েকটি দেশ এখন ইরানকে সরাসরি তাদের নিজস্ব পরমাণু ওয়ারহেড সরবরাহ করতে প্রস্তুত রয়েছে। মেদভেদেভ দাবি করেন, যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর ইরানের রাজনৈতিক নেতৃত্ব আরও শক্তিশালী হয়েছে। যারা আগে সরকারের প্রতি নিরপেক্ষ বা বিরূপ মনোভাব পোষণ করত, তারাও এখন দেশের আধ্যাত্মিক নেতৃত্বের চারপাশে ঐক্যবদ্ধ হয়ে উঠছে। এদিকে রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেছে, সার্বভৌম একটি রাষ্ট্রের ভূখণ্ডে ক্ষেপণাস্ত্র ও বোমা হামলা চালানো আন্তর্জাতিক আইন, জাতিসংঘ সনদ এবং জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্তের চরম লঙ্ঘন। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, আমরা এই আগ্রাসনের অবসান চাই এবং রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পন্থায় ফিরে আসার জন্য সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর প্রতি আহ্বান জানাই।

ট্রাম্প নিজেই যুক্তরাষ্ট্রকে নতুন যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছেন: দিমিত্রি মেদভেদেভ

মধ্যপ্রাচ্যে ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনার মধ্যে সরাসরি সামরিক অভিযানে জড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। স্থানীয় সময় শনিবার (২১ জুন) মধ্যরাতে মার্কিন বি-২ বোমারু বিমান থেকে ইরানের ৩টি উচ্চ-নিরাপত্তা সম্পন্ন পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালানো হয়। ইসরায়েলের সঙ্গে সমন্বয় করে এই হামলা পরিচালিত হছে বলে ট্রাম্প তার ভাষণে উল্লেখ করেছেন। এই হামলার প্রতিক্রিয়ায় রাশিয়ার নিরাপত্তা পরিষদের ডেপুটি চেয়ারম্যান এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে কটাক্ষ করে মন্তব্য করেছেন, ট্রাম্প নিজেই যুক্তরাষ্ট্রকে এক নতুন যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছেন। খবর আল-জাজিরার। রোববার (২২ জুন) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ‘এক্স’-এ (সাবেক টুইটার) এক পোস্টে মেদভেদেভ ট্রাম্পকে উদ্দেশ করে লেখেন, নিজেকে ‘শান্তি প্রতিষ্ঠাকারী’ দাবি করা সেই ট্রাম্পই এখন একটি নতুন যুদ্ধ শুরু করলেন। তিনি বলেন, ইরানের ৩টি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়ে যুক্তরাষ্ট্র আদতে কী অর্জন করলো? ইরানের ওই স্থাপনাগুলোর বড় কোনো ক্ষতিই হয়নি। শুধু শুধু এক নতুন যুদ্ধের সূচনা। মেদভেদেভ আরও লিখেন, এ ধরনের সাফল্যের পর এখন শান্তির নোবেল পুরস্কারের চিন্তা একেবারেই বাদ দিতে পারেন ট্রাম্প। অভিনন্দন, দারুণ এ শুরুর জন্য, মি. প্রেসিডেন্ট! প্রসঙ্গত, মাত্র কয়েকদিন আগেই ট্রাম্প নিজেকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের উপযুক্ত দাবিদার হিসেবে দাবি করেন। তিনি বলেন, বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় তার ভূমিকা অনন্য। এমনকি পাকিস্তান সরকারও তার নাম নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে সুপারিশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। বিশ্লেষকদের মতে, রাশিয়ার এ ধরনের মন্তব্য কেবল কূটনৈতিক ব্যঙ্গ নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য নীতির প্রতি একপ্রকার কৌশলগত বার্তা। মস্কো স্পষ্টভাবে দেখাতে চাইছে, ওয়াশিংটন ‘শান্তি’ নয়, বরং আগ্রাসনের পথেই হাঁটছে।

হরমুজ প্রণালী বন্ধের অনুমোদন দিল ইরানের সংসদ

ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের মধ্যে হরমুজ প্রণালী বন্ধ করা বিষয়ক সিদ্ধান্তের অনুমোদন দিয়েছে ইরানি সংসদ। রোববার (২২ জুন) দেশটির রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন গণমাধ্যম প্রেস টিভির বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, দেশের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা সংস্থাকে এখন এই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করতে হবে। বৈশ্বিক তেল রপ্তানির বড় একটি অংশ পরিবহনে ব্যবহৃত হয় হরমুজ প্রণালী। এই প্রণালীর উত্তরে ইরান, দক্ষিণে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ওমান অবস্থিত। এটি বন্ধ হলে তেল পরিবহনের জন্য আর বিশেষ কোনো বিকল্প পথ খোলা থাকবে না। মার্কিন জ্বালানি তথ্য প্রশাসনের মতে,, ২০২৪ সালে বিশ্বব্যাপী মোট তেলের প্রায় ২০ শতাংশ হরমুজ প্রণালীর মধ্য দিয়ে রপ্তানি হয়েছিল।

হামলার কথা ইরানকে আগেই জানিয়ে ছিল যুক্তরাষ্ট্র

ইরানে মার্কিন বিমান হামলার আগেই তেহরানকে গোপনে সতর্ক করেছিল ওয়াশিংটন। ‘সম্পূর্ণ যুদ্ধ’ এড়াতে এমন পদক্ষেপ নেয় যুক্তরাষ্ট্র- এমন দাবি করেছে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আমওয়াজ মিডিয়া। রোববার (২২ জুন) টিআরটি গ্লোবাল তাদের প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়। সংবাদমাধ্যমটির খবরে বলা হয়, শনিবার (২১ জুন) মধ্যরাতে ইরানের ৩টি প্রধান পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্র ভয়াবহ বিমান হামলা চালানোর আগে তেহরানকে জানিয়ে দেয়- হামলার লক্ষ্য হবে শুধুই ফোরদো, ইসফাহান ও নাতানজ স্থাপনা একইসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র কোনো পূর্ণমাত্রার সামরিক সংঘাতে জড়াতে চায় না। প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, আমওয়াজ মিডিয়াকে দেওয়া বক্তব্যে একজন জ্যেষ্ঠ ইরানি রাজনৈতিক সূত্র, নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, এ সতর্কবার্তার পর ইরানি কর্মকর্তারা তৎক্ষণাৎ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। পারমাণবিক সাইটগুলো থেকে ‘অধিকাংশ’ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম গোপন স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়। এর ফলে বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা থেকে আংশিকভাবে রক্ষা পায় ইরান। তবে যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ইরান- কোনো পক্ষই আনুষ্ঠানিকভাবে এ তথ্যের সত্যতা স্বীকার করেনি। এদিকে যুক্তরাজ্য সরকারকেও হামলার আগে বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত থাকার কথা জানিয়েছেন দেশটির ব্যবসা ও বাণিজ্য মন্ত্রী জোনাথন রেনল্ডস। এতে বোঝা যায়, এই হামলা ছিল পূর্বপরিকল্পিত ও আন্তর্জাতিক মিত্রদের সঙ্গে সমন্বিত একটি সামরিক পদক্ষেপ। প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের তিনটি বি-২ বোমারু বিমান ফোরদো পারমাণবিক স্থাপনায় ছোড়ে ছয়টি ১৩.৬ কেজি ওজনের ‘ম্যাসিভ অর্ডন্যান্স পেনিট্রেটর’ (এমওপি) বোমা। এর মধ্যে দুটি করে আঘাত হানে সাইটটির সুরক্ষিত দুটি প্রবেশপথে এবং দুটি বোমা ফেলা হয় বায়ুচলাচল নল লক্ষ্য করে। এছাড়া একটি মার্কিন সাবমেরিন থেকে নাটানজ ও ইসফাহান পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর ৩০টি টমাহক ক্রুজ মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়। এই দুই স্থাপনায় এর আগেও ইসরায়েলি বাহিনী হামলা চালিয়েছিল বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। ফক্স নিউজ-এর বরাত দিয়ে জানানো হয়, এক মার্কিন কর্মকর্তা বলেন- সবাই ফোরদো নিয়ে কথা বলছিল, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সবচেয়ে কঠিন লক্ষ্য ছিল ইসফাহান। এই মন্তব্য থেকেই ধারণা করা যায়, অপারেশনটি শুধু প্রতীকী ছিল না- বরং এতে ছিল জটিল পরিকল্পনা ও অগ্রাধিকারভিত্তিক লক্ষ্যবস্তুর হিসাব। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, আমরা ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দিয়েছি। ভবিষ্যতে যদি হামলা চালানো হয়, তাহলে তা হবে আরও ভয়াবহ। অপরদিকে ইরান এই হামলাকে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন বলে আখ্যা দিয়ে কঠোর নিন্দা জানিয়েছে। দেশটির পারমাণবিক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এ ঘটনায় আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। এর আগে তেহরান জাতিসংঘের পরমাণু পর্যবেক্ষক সংস্থা আইএইএ-কে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে ‘সত্য গোপনের’ অভিযোগে অভিযুক্ত করেছিল। বিশ্লেষকদের মতে, সামরিক উত্তেজনার পাশাপাশি এই ঘটনার ভেতর দিয়ে এক ধরনের ‘কূটনৈতিক সংকেত’ আদান-প্রদানও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আগাম বার্তা পাঠানো, লক্ষ্য সীমাবদ্ধ রাখা এবং ইরানের পূর্বপ্রস্তুতি- সবই ইঙ্গিত দেয়, দুই পক্ষের মধ্যে এখনো কূটনৈতিক যোগাযোগের রেখা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়নি।

আমাদের হামলার লক্ষ্য ইরানের সরকার পরিবর্তন নয়: মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী

ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার লক্ষ্য দেশটির সরকারের পরিবর্তনের লক্ষ্যে নয় বলে জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিটার হেগসেথ। মার্কিন প্রতিরক্ষা সদর দপ্তর পেন্টাগনে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, এই মিশনের লক্ষ্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ওপর আসা ইরানের হুমকি ঠেকানো। খবর আল জাজিরার। সংবাদ সম্মেলনে ইরানের বর্তমান সরকারে পরিবর্তন যুক্তরাষ্ট্রের নীতিগত লক্ষ্য কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে হেগসেথ বলেন, এই মিশনের লক্ষ্য তা ছিল না; বরং ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি থেকে আমাদের জাতীয় স্বার্থের ওপর আসা হুমকি ঠেকানোয় ছিল আমাদের মূল উদ্দেশ্য। তিনি এটিকে ‘একটি নির্ভুল সামরিক অভিযান’ বলেও দাবি করেন। মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী আরও বলেন, মার্কিন সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা ‘প্রায় সীমাহীন’ এবং ইরানে আমরা হামলার পরিধি ‘ইচ্ছাকৃতভাবে সীমিত’ করেছি। আমরা সেই বার্তাই পাঠাচ্ছি। এদিকে, হেগসেথ এখনো আশা করেন যে ইরান আলোচনায় ফিরে আসবে। তার দাবি, ইরান সঠিকভাবে জানে যে যুক্তরাষ্ট্রের দাবিগুলো পূরণের জন্য কী পদক্ষেপ নিতে হতে পারে। ‘আমি কেবল নিশ্চিত করতে পারি যে ইরানিদের কাছে একাধিক চ্যানেলে প্রকাশ্য ও ব্যক্তিগতভাবে বার্তা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে, যা তাদের আলোচনার টেবিলে আসার প্রতিটি সুযোগ করে দিচ্ছে।’

ইরানে মার্কিন হামলায় কোনো প্রাণহানি হয়নি

ইরানের তিনটি পারমাণবিক কেন্দ্রে মার্কিন বিমান বাহিনী হামলায় কোনো প্রাণহানির কোনো ঘটনা ঘটেনি বলে দাবি করেছেন ইরানের রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির প্রধান পীর হোসেইন কোলিভান্দ। খবর আলজাজিরার। গতকাল শনিবার (২১ জুন) রাতে ইরানের তিনটি পারমাণবিক কেন্দ্রে (ফোরদো, নাতাঞ্জ ও ইস্পাহান) মার্কিন বিমান বাহিনী হামলা চালিয়েছে। এই হামলার পর মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা চরম আকার ধারণ করেছে এবং ইরান এর তীব্র নিন্দা জানিয়ে পাল্টা জবাব দেওয়ার হুমকি দিয়েছে। ইরানের রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির প্রধান দেশটির রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের বরাত দিয়ে বলেন, গত রাতে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসনে পরমাণু স্থাপনাগুলোতে হামলার ঘটনায় সৌভাগ্যক্রমে আমাদের কেউ শহীদ হননি। এদিকে হামলার পর করণীয় নির্ধারণে আজ রোববার (২২ জুন) মস্কোর উদ্দেশে রওনা দিচ্ছেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি। আগামীকাল সোমবার (২৩ জুন) তিনি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করবেন ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইসরায়েলের গত ১৩ জুনের হামলা শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত ৪৩০ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত এবং ৩,৫০০ এর বেশি আহত হয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন ট্রাম্প: আব্বাস আরাগচি

ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের হামলা প্রসঙ্গে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি বলেন, ‘এই হামলার মাধ্যমে ট্রাম্প শুধু ইরানই নয়, বরং আমেরিকার জনগণের সাথেও বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন ট্রাম্প।’ বিবিসি জানিয়েছে এক টেলিভিশন ভাষনে এসব কথা বলেন আরাগচি। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘ট্রাম্প যখন প্রেসিডেন্ট হন, তখন বলেছিলেন তিনি মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার দীর্ঘ ও ব্যয়বহুল যুদ্ধে জড়ানো বন্ধ করবেন। কিন্তু এখন তিনি তা না করে উল্টো আমাদের সঙ্গে কূটনীতির নামে প্রতারণা করেছেন এবং আমেরিকার জনগণকেও ঠকিয়েছেন।’ আব্বাস আরাগচি বলেন, ‘তিনি এমন একজন যুদ্ধাপরাধীর নির্দেশে কাজ করছেন, যিনি বহুদিন ধরে আমেরিকার মানুষ ও তাদের অর্থ ব্যবহার করে ইসরায়েলের স্বার্থে কাজ করে যাচ্ছে।’ এদিকে ইরানে হামলার পর ট্রাম্প বলেন, ‘আমি বিশ্ববাসীকে জানাতে পারি যে, এই হামলাগুলো ছিল একটি অসাধারণ সামরিক সাফল্য। হামলার লক্ষ্যবস্তু ছিল ইরানের গোপন পারমাণবিক সমৃদ্ধিকরণ কেন্দ্র ফোরদো, নাতাঞ্জ ও ইসফাহানের স্থাপনাগুলো। এ হামলায় ইরানের প্রধান পারমাণবিক সমৃদ্ধিকরণ সুবিধাগুলো সম্পূর্ণ ও চূড়ান্তভাবে ধ্বংস হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের দাম্ভিক শক্তি ইরানকে এখন অবশ্যই শান্তির পথ বেছে নিতে হবে।’ ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ওই হামলার জন্য ট্রাম্পকে অভিনন্দন জানান।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি শেষ হয়ে গেছে, সামরিক প্রতিক্রিয়ার প্রস্তুতি চলছে: হুথি

ইয়েমেনের আনসারুল্লাহ আন্দোলনের (হুথি) রাজনৈতিক ব্যুরো ঘোষণা করেছে, ইরানের ওপর মার্কিন হামলার পর 'আপস শেষ হয়ে গেছে' এবং যুক্তরাষ্ট্রকে এখন ইয়েমেনের 'সামরিক প্রতিক্রিয়ার জন্য' অপেক্ষা করতে হবে। মেহের নিউজ এজেন্সি জানিয়েছে, হুথি'র রাজনৈতিক ব্যুরো সদস্য মোহাম্মদ আল-বুখাইতি বলেছেন, ইরানের বিরুদ্ধে আগ্রাসনের আগে আমেরিকার সাথে আমাদের চুক্তি হয়েছিল। আজ আমরা যুক্তরাষ্ট্র এবং ইহুদিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে ইরানে আমাদের ভাইদের পাশে দাঁড়িয়েছি। তিনি ঘোষণা করেন, আমাদের সামরিক প্রতিক্রিয়া আসছে এবং প্রথম পর্যায়ে আমরা লোহিত সাগরে আমেরিকান বাহিনীকে লক্ষ্যবস্তু করব। এর আগে রোববার (২২ জুন) ভোরে যুক্তরাষ্ট্র বি-২ স্টেলথ বোমারু বিমান দিয়ে ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় আক্রমণ চালায়। হামলার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেন, মার্কিন বিমান বাহিনী ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় সফল আক্রমণ চালিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর মোদির সঙ্গে ইরানের প্রেসিডেন্টের ফোনালাপ

ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় গতকাল শনিবার মধ্যরাতের পর বোমা হামলায় চালায় যুক্তরাষ্ট্র। হামলার প্রেক্ষাপটে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি রোববার (২২ জুন) ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রের বরাত দিয়ে জানায়, ৪৫ মিনিটের এই ফোনালাপের উদ্যোগ এসেছিল ইরানের প্রেসিডেন্ট পেজেশকিয়ানের কাছ থেকে। যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পরমাণু স্থাপনায় হামলার পরেই তিনি এই উদ্যোগ নেন। নরেন্দ্র মোদি সাম্প্রতিক এই অস্থিরতায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। অবিলম্বে উত্তেজনা কমানো এবং সংলাপ ও কূটনীতির মাধ্যমে আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানিয়েছেন মোদি। ইরানের প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রী মোদিকে বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে বিস্তারিত অবহিত করেন এবং ভারতকে আঞ্চলিক শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা বৃদ্ধিতে ‘ঘনিষ্ঠ মিত্র ও অংশীদার’ হিসেবে অভিহিত করেন। এদিকে এই হামলার প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ড কোর (আইআরজিসি)। বলেছে, ইরানে হামলা করে যুক্তরাষ্ট্র অপরাধ করেছে। মার্কিন সরকার অতীতের মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধগুলো থেকে শিক্ষা নেয়নি। ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় আজকের বোমা হামলার জন্য পরিণতি ভোগ করবে যুক্তরাষ্ট্র। বিবৃতিতে আইআরজিসি বলছে, বারবারের ব্যর্থ হামলা থেকে যুক্তরাষ্ট্র শিক্ষা নেওয়ার পরিবর্তে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় আঘাত হানে। এবারের হামলায় অংশ নিয়ে ওয়াশিংটন আগ্রাসনের সামনের সারিতে এসে দাঁড়িয়েছে। সতর্ক করে আইআরজিসি বলছে, মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সামরিক ঘাঁটির সংখ্যা, বিস্তার এবং আকার কোনো শক্তি নয়। বরং এর ফলে এই অঞ্চলে তাদের দুর্বলতা দ্বিগুণ করেছে।

ইসরায়েলে হামলার শঙ্কায় ঘর ছাড়া ৯ হাজার বাসিন্দা

ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার শঙ্কায় প্রায় ৯ হাজার ইসরায়েলি বাসিন্দা বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। দেশটির জরুরি উদ্ধারকারীরা বলছেন, রোববার (২২ জুন) সকাল থেকেই ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে তেল আবিবসহ বিভিন্ন শহরে বেশ কিছু ভবনের মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। খবর টাইমস অব ইসরায়েলের। ইসরায়েলের স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ফেডারেশন জানিয়েছে, ইরানের চালানো ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় বেসামরিক আবাসিক এলাকাগুলোতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও লাগাতার হামলার আতঙ্কে এই বিপুল সংখ্যক মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। সামরিক অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে প্রায় ৯ হাজার ইসরায়েলি বাসিন্দা তাদের বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন। ফেডারেশনের তথ্য অনুযায়ী, বাস্তুচ্যুত হাজার হাজার মানুষকে বর্তমানে বিভিন্ন হোটেলে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। বাকিরা তাদের বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে চলে গেছেন। ইসরায়েলের বেসামরিক আবাসিক এলাকা লক্ষ্য করে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ দেখা গেছে। গত ১৩ জুন ইসরায়েল ইরানের সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা শুরু করার পর থেকেই দুই দেশের মধ্যে তীব্র সংঘাত চলছে। শনিবার রাতে দেশটির পারমাণবিক স্থাপনায় মার্কিন হামলার পর থেকে ইসরায়েলে ভারি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ছে ইরান। যার ফলে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে।

নেতানিয়াহু থাকবে না, ইরান টিকে থাকবে: রাশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট

রাশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং দেশটির নিরাপত্তা কাউন্সিলের উপপ্রধান দিমিত্রি মেদভেদেভ বলেছেন, ইসরায়েলের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু থাকবেন না, একদিন তিনি বিদায় নেবেন। কিন্তু ইরান একটি প্রাচীন সভ্যতার দেশ, একটি দীর্ঘস্থায়ী রাষ্ট্র যা ভবিষ্যতেও থাকবে। শনিবার (২২ জুন) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া এক বিবৃতিতে মেদভেদেভ এই বক্তব্য দেন। তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের অন্যতম ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে পরিচিত এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে তার মন্তব্যকে গুরুত্ব দিয়েই দেখা হয়। মেদভেদেভ বলেন, ‘ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু একদিন বিদায় নেবেন; কিন্তু ইরান থাকবে, তার ভূখণ্ড থাকবে, তার জনগণ থাকবে, তার সংস্কৃতি থাকবে। ইরান ইতিহাসে ছিল, আছে এবং থাকবে।’ তিনি আরও বলেন, ইসরায়েলের গোপন পারমাণবিক কর্মসূচি আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি তৈরি করছে। তেল আবিব কীভাবে দীর্ঘদিন ধরে পারমাণবিক অস্ত্র গোপনে উৎপাদন করে যাচ্ছে, অথচ আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (IAEA) সেসব কার্যক্রমে তেমন হস্তক্ষেপ করছে না এটা একটা প্রশ্নবিদ্ধ বিষয়। তিনি তীব্রভাবে প্রশ্ন তোলেন, কেন ইসরায়েলের জন্য পারমাণবিক কর্মসূচি গ্রহণযোগ্য আর ইরানের জন্য নয়? একই মানদণ্ডে বিচার হওয়া উচিত। ন্যায্যতা ও আন্তর্জাতিক আইনের ভিত্তিতেই সবকিছু পরিচালিত হওয়া দরকার। রাশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্টের এই মন্তব্য এমন এক সময়ে এলো, যখন মধ্যপ্রাচ্যে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছে। ইসরায়েল সম্প্রতি একাধিকবার ইরানি স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে, যার জবাবে ইরানও প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে সামরিকভাবে। এ পরিস্থিতিতে রাশিয়ার এমন অবস্থান আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। মেদভেদেভের মন্তব্যে আরও একবার স্পষ্ট হলো যে, রাশিয়া কৌশলগতভাবে ইরানের পাশে রয়েছে এবং ইসরায়েলের একচেটিয়া আধিপত্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অবস্থানে রয়েছে।

ইরানে মার্কিন হামলার তীব্র নিন্দা জানাল চীন

ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় বিমান হামলা চালিয়ে যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন করেছে বলে অভিযোগ করেছে চীন। এই হামলার নিন্দা জানিয়ে বেইজিং বলেছে, মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি করছে যুক্তরাষ্ট্র। রোববার চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া এক বিবৃতিতে অবিলম্বে ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘‘ইরানে মার্কিন হামলা এবং আইএইএর নিরাপত্তা তত্ত্বাবধানে থাকা পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে বোমাবর্ষণের কঠোর নিন্দা জানায় চীন।” বিবৃতিতে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, ‘‘যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের কার্যকলাপ জাতিসংঘ সনদের উদ্দেশ্য, নীতিমালা এবং আন্তর্জাতিক আইনের গুরুতর লঙ্ঘন করেছে। এই হামলার কারণে মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা বেড়েছে।’’ চীন সব পক্ষ—বিশেষ করে ইসরায়েলকে দ্রুত যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছাতে, বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং সংলাপ ও আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানের আহ্বান জানিয়েছে। বিবৃতিতে বেইজিং বলেছে, ‘‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে একসাথে কাজ করার জন্য প্রস্তুত রয়েছে চীন; যাতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি এবং স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারে যৌথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়।’’ শনিবার রাতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী ইরানের তিনটি প্রধান পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে বলে জানান। তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেন, তেহরান শান্তিতে রাজি না হলে আরও বিধ্বংসী হামলার মুখোমুখি হবে। এদিকে, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে রাশিয়া। একই সঙ্গে ইরানে মার্কিন এই হামলাকে ‘‘দায়িত্বজ্ঞানহীন’’ ও আন্তর্জাতিক আইনের চরম লঙ্ঘন বলেও অভিহিত করেছে মস্কো। রোববার রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘‘যেকোনও যুক্তিই দেখানো হোক না কেন, একটি সার্বভৌম দেশের ভূখণ্ডে ক্ষেপণাস্ত্র ও বোমা হামলা চালানোর মতো এই দায়িত্বজ্ঞানহীন সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক আইন, জাতিসংঘ সনদ এবং জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবনার স্পষ্ট লঙ্ঘন।’’ রুশ লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (এলডিপিআর) নেতা লিওনিদ স্লুটস্কি বলেছেন, এই হামলার কোনও সামরিক কারণ ছিল না এবং আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় এর কোনও বৈধতা নেই। রাশিয়ার পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ স্টেট দুমার ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স কমিটির প্রধান লিওনিদ বলেন, এই উত্তেজনার ফলাফল শুধু এই অঞ্চলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। ওয়াশিংটন জানে, তেহরানের জবাব অবধারিত। এসব কিছু সংঘাতের চক্রকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এবং তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। সূত্র: এএফপি, বিবিসি।

পুতিনের সঙ্গে ‘গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা’ করতে রাশিয়া যাচ্ছেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী

যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালানোর পর আজ মস্কো সফরে যাচ্ছেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি। সেখানে আগামীকাল (সোমবার) রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাতের কথা রয়েছে তার। ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নিতে বর্তমানে ইস্তাম্বুলে অবস্থান করছেন আরাগচি। রোববার (২২ জুন) ইস্তাম্বুলে এক সংবাদ সম্মেলনে আব্বাস আরাগচি বলেন, ‘আমি আগামীকাল রুশ প্রেসিডেন্টের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করব এবং আমরা একসঙ্গে কাজ চালিয়ে যাব।’ তিনি বলেন, ‘রাশিয়া ইরানের বন্ধু এবং আমাদের মধ্যে কৌশলগত অংশীদারত্ব রয়েছে। বিভিন্ন ইস্যুতে আমরা সবসময় পরস্পরের সঙ্গে পরামর্শ করে আমাদের অবস্থান সমন্বয় করি।’ এ সময় রাশিয়া ইরানের পারমাণবিক চুক্তির (জেসিপিওএ) অন্যতম স্বাক্ষরকারী ছিল - মনে করিয়ে দেন আরাগচি।

বিপজ্জনক যুদ্ধ শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র : ইরান

ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর যুক্তরাষ্ট্রের হামলাকে “ইরানের বিরুদ্ধে বিপজ্জনক যুদ্ধের সূচনা” বলে উল্লেখ করেছে ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। দেশটির আধা-সরকারি সংবাদ সংস্থা তাসনিমে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে এ মন্তব্য করা হয়। খবর সিএনএনের। বিবৃতিতে বলা হয়, “বিশ্ব যেন ভুলে না যায়—যুক্তরাষ্ট্র কূটনৈতিক আলোচনার মধ্যেই বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।” ইসরায়েলকে “গণহত্যাকারী ও আইনবহির্ভূত রাষ্ট্র” হিসেবে আখ্যা দিয়ে, যুক্তরাষ্ট্রকে “ইরানের বিরুদ্ধে একটি বিপজ্জনক যুদ্ধ শুরু করার” জন্য অভিযুক্ত করা হয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, এই হামলা জাতিসংঘ সনদ ও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেছে এবং এর জন্য ভয়াবহ পরিণতির পুরো দায় যুক্তরাষ্ট্রকেই বহন করতে হবে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, “যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক আগ্রাসন এবং এই অবাধ্য রাষ্ট্র (ইসরায়েল)-এর অপরাধের বিরুদ্ধে পূর্ণ শক্তি দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলা এবং ইরানের জাতীয় নিরাপত্তা ও স্বার্থ রক্ষায় প্রয়োজনীয় সব উপায় গ্রহণ করা ইরানের বৈধ অধিকার।” পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জাতিসংঘ ও এর বিভিন্ন অঙ্গসংগঠন, বিশেষ করে পারমাণবিক পর্যবেক্ষক সংস্থা আইএইএকে “এই ভয়াবহ ও বেআইনি হামলা দ্রুত বিবেচনায় নেওয়ার” আহ্বান জানায়। একই সঙ্গে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রতি জরুরি বৈঠক ডেকে হামলার নিন্দা জানানোর আহ্বান জানানো হয়। এর আগে, শনিবার ইরানের ফোর্ডো, ইসফাহানসহ তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প স্থানীয় সময় শনিবার (২১ জুন) ট্রুথ স্যোশাল প্লাটফর্মে এক পোস্টে এ তথ্য জানান।

ইরানে মার্কিন হামলার প্রতিক্রিয়ায় যা বলছেন বিশ্বনেতারা

ইরানে হামলা চালানোর ঘোষণা আগেই দিয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে এটিকে স্রেফ ‘হুমকি’ ভেবেছিলেন অনেকে। কিন্তু গতকাল শনিবার (২১ জুন) মধ্যরাতের পর ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়ে বসেছেন ট্রাম্প। এর মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের চলমান সংঘাতে সরাসরি জড়িত হলো যুক্তরাষ্ট্র। ট্রাম্পের এ পদক্ষেপে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে সংঘাত আরও ভয়ঙ্কর রূপ নিতে পারে। এ হামলার নিন্দা জানিয়েছেন বিশ্বনেতা ও কূটনীতিকদের অনেকেই। আবার কেউ কেউ উত্তেজনা প্রশমনের আহ্বানও জানিয়েছেন। ট্রাম্পের হামলার প্রতিক্রিয়ায় কী বলছেন বিশ্বনেতারা, তা তুলে ধরেছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমস। জাতিসংঘ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক পোস্টে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, তিনি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। তিনি এ হামলাকে উত্তেজনাপূর্ণ একটি অঞ্চলে বিপজ্জনক মাত্রায় উত্তেজনা বৃদ্ধির ঘটনা হিসেবে বর্ণনা করেছেন। একে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য সরাসরি হুমকি বলেও উল্লেখ করেছেন তিনি। গুতেরেস সতর্ক করে বলেন, ‘এই সংঘাত দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে; যা বেসামরিক মানুষ, এতদঞ্চল ও সারা বিশ্বের জন্যই ভয়ানক পরিণতি ঢেকে আনতে পারে।’ যুক্তরাজ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার বলেন, ‘ইরানকে কখনোই পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করতে দেওয়া যাবে না। যুক্তরাষ্ট্র সেই হুমকি কমাতে পদক্ষেপ নিয়েছে।’ তিনি ইরানকে আলোচনার টেবিলে ফেরার ও এ সংকটের একটি কূটনৈতিক সমাধানে পৌঁছার আহ্বান জানান। অস্ট্রেলিয়া অস্ট্রেলিয়া সরকারের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আমরা পরিষ্কারভাবে বলেছি, ইরানের পারমাণবিক ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য একটি হুমকি।’ নিউজিল্যান্ড নিউজিল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইনস্টন পিটার্স কূটনৈতিক প্রক্রিয়ার সংকট সমাধানের আহ্বান জানিয়ে এক বিবৃতিতে বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে চলমান সামরিক কর্মকাণ্ড অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এ উত্তেজনা যাতে আর না বাড়ে, তা নিশ্চিত করা খুব গুরুত্বপূর্ণ।’ মেক্সিকো মেক্সিকোর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংঘাতে জড়িত পক্ষগুলোর প্রতি কূটনৈতিক সংলাপ শুরু করা ও শান্তি প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছে। চিলি প্রেসিডেন্ট গাব্রিয়েল বোরিক বলেন, আন্তর্জাতিক আইনে এ হামলা অবৈধ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি লেখেন, ‘আমরা শান্তি চাই এবং শান্তি প্রয়োজন।’ ভেনেজুয়েলা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইভান গিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টেলিগ্রামে এক পোস্টে ইরানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের হামলাকে অবৈধ, অযৌক্তিক ও ভীষণ বিপজ্জনক আগ্রাসন বলে বর্ণনা করেছেন। সৌদি আরব বিবিসি জানায়, সৌদি আরবের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, রিয়াদ গভীর উদ্বেগের সঙ্গে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানে চলমান পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে, বিশেষ করে দেশটির পারমাণবিক স্থাপনাগুলো লক্ষ্য করে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার বিষয়টি। বিবৃতিতে উত্তেজনা কমাতে সংযম প্রদর্শন এবং সংঘাত এড়ানোর প্রয়োজনীয়তার ওপরও গুরুত্ব আরোপ করা হয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি এ সংকটের একটি রাজনৈতিক সমাধানে পৌঁছার প্রচেষ্টা জোরদার করার আহ্বানও জানিয়েছে সৌদি আরব। ওমান আল–জাজিরা জানায়, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দেশটির আলোচনায় মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করছিল ওমান। ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের হামলাকে অবৈধ আগ্রাসন বলে উল্লেখ করে এ কর্মকাণ্ডের নিন্দা জানিয়েছে দেশটি। ওমান তাৎক্ষণিকভাবে ও সর্বাত্মক উত্তেজনা প্রশমনেরও আহ্বান জানিয়েছে। ওমান নিউজ এজেন্সিকে ওমানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বলেন, দেশটি এ ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে এবং সতর্ক করে বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপ সংঘাত আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। এটি আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘ সনদেরও স্পষ্ট লঙ্ঘন। কাতার যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর এ অঞ্চলে যে বিপজ্জনক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে, তা আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভয়ানক পরিণতি ডেকে আনতে পারে বলে সতর্ক করে দিয়েছে কাতার। ইরাক ইরাক প্রতিবেশী ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে এ পদক্ষেপের নিন্দা জানিয়েছে। এ হামলায় যে সামরিক উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে, তা আঞ্চলিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য গুরুতর হুমকি সৃষ্টি করেছে বলেও উল্লেখ করেছে দেশটি।

ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরাইলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি, আহত ৮৬

শনিবার রাতে চালানো মার্কিন জবাবে রোববার সকালে ইসরাইলের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইরান।ইরানের সর্বশেষ এ হামলায় ইসরাইলে অন্তত ৮৬ জন আহত হয়েছে এবং তাদের চিকিৎসা চলছে বলে জানিয়েছে ইসরাইল। দৈনিক ইসরাইল হাইয়োম-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইরান অন্তত ৪০টি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে। যেগুলো হাইফা, তেলআবিব ও ইসরাইলের উপকূল ও মধ্যাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে আঘাত হেনেছে। ইসরাইলের সরকারি সম্প্রচারমাধ্যম কেএএন জানিয়েছে, ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রগুলো কমপক্ষে ১০টি ভিন্ন স্থানে আঘাত করেছে। চ্যানেল ১৪ নিশ্চিত করেছে, পাঁচটি ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র ইসরাইলি ভূখণ্ডে আঘাত করেছে। যার মধ্যে তিনটি হাইফা অঞ্চলে এবং দুটি কেন্দ্রীয় ইসরাইলে পড়েছে। চ্যানেল ১২ বলছে, হাইফায় “অস্বাভাবিক এক ঘটনা” ঘটেছে এবং সেখানে বহু বিস্ফোরণ হয়েছে। এছাড়া সতর্কতা সংকেত বেজে উঠেছে উত্তর ও মধ্য ইসরাইলের বিভিন্ন স্থানে। বিশেষ করে হাইফা শহরে, যেখানে এর আগের হামলাগুলোর সময় কোনো আগাম সতর্কতা শোনা যায়নি। ইয়েদিওথ আহরোনোথ-এর মতে, হাইফায় গুরুতর অবকাঠামোগত ক্ষতি হয়েছে এবং শেফেলাহ অঞ্চল ও ডান ব্লকে (যার মধ্যে তেল আবিব ও তার উপশহরগুলো অন্তর্ভুক্ত) অতিরিক্ত ক্ষতির খবর পাওয়া গেছে। কেএএন জানিয়েছে, তেলআবিবের আশপাশে একটি ভবনে সরাসরি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হেনেছে এবং উপকূলীয় অঞ্চলে বহু ভবন ধ্বংস হয়েছে। এদিকে ইসরাইলের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার কারণে ৮৬ জন আহত ব্যক্তিকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। যার মধ্যে দুজনের অবস্থা মাঝারিমানের, ৭৭ জনের অবস্থা ভালো এবং চারজন তীব্র উদ্বেগজনিত সমস্যায় ভুগছেন। এছাড়া তিনজনের চিকিৎসা মূল্যায়ন চলছে। অন্যদিকে, ইসরাইলি সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, ইরানি হামলার জবাবে দেশটিতে পালটা বিমান হামলা চালানো হয়েছে। কিছুক্ষণ আগে ইরানের দেজফুল বিমানবন্দরে ইসরাইলি বিমান বাহিনী দুটি ইরানি এফ-৫ যুদ্ধবিমানে বোমা হামলা চালিয়েছে। এছাড়াও রোববার সকালে চালানো হামলায় ইরানের আটটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র লঞ্চার ধ্বংস করা হয়েছে, যার মধ্যে ছয়টি ইসরাইলের উপর তাৎক্ষণিক আক্রমণের জন্য তৈরি ছিল। এর আগে ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) বরাত দিয়ে আল-জাজিরা ও টাইমস অব ইসরাইল জানায়, রোববার সকালে ইরান থেকে একাধিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়েছে।এ হামলাকে গত ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ইরানের প্রথম সরাসরি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। ইরানি হামলার কথা স্বীকার করে আইডিএফ ইসরাইলি বাসিন্দাদের সতর্ক করে বলেছে, “কয়েক মিনিটের মধ্যেই কেন্দ্রীয় ও উত্তর ইসরাইলের বিভিন্ন এলাকায় সাইরেন বেজে ওঠে।” এ ঘোষণার পর ইসরাইলের বিভিন্ন অংশে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে এবং বেসামরিক নাগরিকদের আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়। এদিকে আইডিএফ জানিয়েছে, ইরান থেকে ইসরাইলে ছোড়া দুটি ড্রোন কিছুক্ষণ আগে ইসরাইলি বিমানবাহিনী গুলি করে ভূপাতিত করেছে। এর আগে ইরানের ড্রোন হামলার কারণে দক্ষিণ আরাভা অঞ্চলে সাইরেন বেজে ওঠে। মূলত ইরান-ইসরাইল চলমান উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে এই হামলা আরও একটি বড় ধাক্কা হিসেবে দেখা হচ্ছে। বিশেষ করে শনিবার রাতে ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর পরিস্থিতি আরও অস্থির হয়ে উঠেছে।

‘যুদ্ধ কেবল শুরু’

যুদ্ধ কেবল শুরু মিস্টার ট্রাম্প। এখন আপনি শান্তির কথা বলছেন? আমরা এমনভাবে আপনার সঙ্গে ডিল করব যেন আপনি দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিণতি বুঝতে পারেন। ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের প্রোগ্রামে এমনভাবেই হুঁশিয়ারি বার্তা দিয়েছেন ইরানি একজন উপস্থাপক। ইরান ইন্টারন্যাশনালের লাইভ প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়েছে। মার্কিন হামলার পর ইরানের কট্টরপন্থী আইনপ্রণেতা হামিদ রাসাই বলেছেন, এই জঘন্য কাজের কঠোর ও জোরালো জবাব দেওয়া হবে। এ ছাড়া ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে আরও বলা হয়েছে, এখন থেকে, এই অঞ্চলে বসবাসকারী প্রতিটি আমেরিকান বেসামরিক ও সামরিক কর্মীকে হামলার বৈধ লক্ষ্যবস্তু হিসেবে বিবেচনা করা হবে। এদিকে ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার পর জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি বলেছেন, ইরানকে এখনই শান্তি স্থাপন করতে হবে। দেশটি যদি এটি না করে, তাহলে ভবিষ্যতে আরও বড় হামলা হবে। দেশটির স্থানীয় সময় শনিবার রাত ১০টায় হোয়াইট হাউস থেকে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ট্রাম্প আরও বলেন, আমি বিশ্বকে আজ রাতে জানাতে পারি, ইরানে হামলা ছিল অসাধারণ সামরিক সাফল্য। এ হামলার উদ্দেশ্য ইরানের পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ সক্ষমতা শেষ করে দেওয়া, সন্ত্রাসের মদদদাতা বিশ্বের এক নম্বরে থাকা দেশটির পারমাণবিক হুমকি থামিয়ে দেওয়া, বলেন ট্রাম্প। এদিকে হামলার পর ট্রাম্পকে অভিনন্দন জানিয়েছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ট্রাম্পও পাল্টা নেতানিয়াহুকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। ট্রাম্প বলেছেন, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র একটি টিম হিসেবে কাজ করেছে।

ইসরায়েলে নতুন করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইরান

ইসরায়েলে নতুন করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইরান। ইসরায়েলজুড়ে বেশ কিছু লক্ষ্যবস্তুকে উদ্দেশ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়েছে দেশটি। ইরানের এই হামলারে মধ্যে জেরুজালেমে একাধিক বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। রোববার (২২ জুন) এই তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম বিবিসি। সংবাদমাধ্যমটি বলছে, ইসরায়েলি ভূখণ্ডের দিকে ইরান থেকে ছোঁড়া ক্ষেপণাস্ত্র কিছুক্ষণ আগে শনাক্ত করেছে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)। এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানিয়েছে আইডিএফ। হুমকি মোকাবিলায় প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা সক্রিয় রয়েছে বলেও জানানো হয়েছে এই বিবৃতিতে। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত জনগণকে সুরক্ষিত একটি স্থানে থাকার আহ্বান জানিয়েছে আইডিএফ। এদিকে ইরান থেকে ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়া হয়েছে, এমন সতর্কবার্তার পরই আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সক্রিয় হওয়ার ফলে জেরুজালেমে একাধিক বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। বিবিসির মধ্যপ্রাচ্য সংবাদদাতা হুগো বাছেগা জেরুজালেম থেকে এ তথ্য জানিয়েছেন। জর্ডানের আম্মানে আজ সকালে শহর জুড়ে দুইবার সাইরেন বেজে উঠেছে, যেটা ইঙ্গিত দেয় ইরানের ছোঁড়া ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। আম্মান থেকে বিবিসির সংবাদদাতা টম বেনেট এ তথ্য জানিয়েছেন। এর আগে জেরুজালেম থেকে বিবিসির সংবাদদাতা একাধিক বিস্ফোরণের শব্দ শোনার কথা জানিয়েছেন। এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো জর্ডানকে টার্গেট করে নয়। তবে জর্ডানের বিমান বাহিনী সাম্প্রতিক দিনগুলোতে এই ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোনগুলো তাদের ভূখণ্ডে অবতরণ করতে পারে মনে করে এগুলোকে প্রতিহত করেছে। ক্ষেপণাস্ত্রগুলোকে বাধা দেওয়া বা প্রতিহত করার ফলে আকাশ থেকে ক্ষেপণাস্ত্রের টুকরো পড়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। এই অঞ্চল জুড়ে বাতিল হওয়া ফ্লাইটের ঢেউয়ের পাশাপাশি পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে এই সংঘাত কিভাবে প্রভাবিত করছে এটি তার আরেকটি লক্ষণ। এর আগে ইরানের তিনটি পরমাণু কেন্দ্র লক্ষ্য করে হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র। রাতের আঁধারে দেশটির ফোর্দো, নাতাঞ্জ আর ইসফাহানের পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্র এসব হামলা চালায়। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাইয়েদ আব্বাস আরাগচি যুক্তরাষ্ট্রের এ হামলাকে ‘গর্হিত’ বলে নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “ইরান তার সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য সব বিকল্প সংরক্ষণ করছে।” সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স এ তিনি লিখেছেন, “আজ সকালের ঘটনাগুলো ভয়াবহ এবং এর পরিণতি চিরস্থায়ী হবে। জাতিসংঘের প্রতিটি সদস্যকে এই অত্যন্ত বিপদজনক, আইনহীন এবং অপরাধমূলক আচরণের জন্য সতর্ক থাকতে হবে।” জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘ সনদের ‘গুরুতর লঙ্ঘন’ করেছে বলেও যোগ করেছেন আরাগচি।