ব্যাংক ব্যবস্থায় আস্থার জন্য খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ জরুরি: সোনালী ব্যাংকের এমডি
- ফরিদ শ্রাবণ
- প্রকাশঃ ০৭:০৯ পিএম, ০৭ জুলাই ২০২৫

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক হলো সেই ব্যাংকগুলো যা সরকারের মালিকানাধীন এবং পরিচালিত হয়। বাংলাদেশে সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক এবং বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (বিডিবিএল) সহ মোট ৬টি রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক রয়েছে। এই ব্যাংকগুলোর প্রধান উদ্দেশ্য হল সরকারের বিভিন্ন নীতি এবং উন্নয়নমূলক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা, যা সাধারণত বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ভিন্ন হয়ে থাকে।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংককে “রাষ্ট্রায়ত্ত প্রধান চারটি বাণিজ্যিক ব্যাংক” এই ব্যাংকগুলোতে এখন খেলাপি ঋণ কমানো একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বর্তমানে সোনালী ব্যাংক পিএলসির সিইও অ্যান্ড ম্যানেজিং ডিরেক্টর (এমডি) মো. শওকত আলী খান। সোনালী ব্যাংকে যোগদানের আগে শওকত আলী খান বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের এমডি হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এর আগে তিনি রূপালী ব্যাংক পিএলসির ডিএমডি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
ব্যাংকটির বর্তমান অবস্থা, আগামীর পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ঢাকাওয়াচ এর বিজনেস এডিটর ফরিদ উদ্দিন শ্রাবন।
ঢাকাওয়াচ : বর্তমানে ব্যাংক খাতে এক ধরনের সংকট চলছে, সেখানে আপনার ব্যাংকের অবস্থান একটু জানতে চাই?
মো. শওকত আলী খান: সোনালী ব্যাংকের আর্থিক অবস্থান অন্য সব ব্যাংকের চেয়ে অনেকগুণ মজবুত। আমরা ঋণ দেয়ার আগে গ্রাহকের সার্বিক আর্থিক পরিস্থিতি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে বিনিয়োগ দিয়ে থাকি। তাই অন্য সব ব্যাংকের চেয়ে আমাদের বিনিয়োগ অনেক ভালো অবস্থানে আছে। ফলে আমাদের খেলাপির পরিমাণ অনেক কম। সার্বিকভাবে বলতে গেলে সোনালী ব্যাংকে কোনো সংকটে নেই। অনেক ব্যাংকের অস্থিরতা কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবে। সেক্ষেত্রে সোনালী ব্যাংকের কোনো প্রকার অস্থিরতা নেই। সঠিক নিয়মেই সোনালী ব্যাংক চলছে। সোনালী ব্যাংকে হলমার্ক ছাড়া বড় কোনো ধরণের কোনো ঋণ নেই। হলমার্কের অর্থ আদায়ের প্রক্রিয়া চলমান।
ঢাকাওয়াচ : সোনালী ব্যাংকের আগামীর পরিকল্পনা নিয়ে জানতে চাই?
মো. শওকত আলী খান: খেলাপী ঋণ আদায় এবং নতুন ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে সিএমএসএমই খাতকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। গ্রাহক সেবার মানকে আধুনিক ও সহজলভ্য করার লক্ষে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ব্যাংকের অত্যন্ত দক্ষ ও বিচক্ষণ পরিচালনা পর্ষদ ও ম্যানেজমেন্টের যৌথ প্রচেষ্টায় সোনালী ব্যাংক অদূর ভবিষ্যতে একটি ব্যাবসায়িক সন্মানজনক অবস্থানে পৌছবে। আমানত, মুনাফা, ঋণ, আমদানি, রপ্তানি, রেমিট্যান্সে সোনালী ব্যাংকের অবস্থান টপ লেভেলে (শীর্ষ পর্যায়ে) আছে। এ ধারাবাহিকতা আমরা ধরে রাখতে চাই। কটেজ, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি (সিএমএসএমই), কৃষি খাতে ঋণ রয়েছে। এ খাতে আরো ঋণ বাড়ানো হবে। তাই যারা ভালো ব্যবসা করতে চাইবে, তাদেরকে আমরা ঋণ দিবে। নতুন করে বড় কোনো কর্পোরেটে খাতে ঋণ দিচ্ছি না। তবে যেগুলো চলমান আছে, সেগুলো ব্যবসার পরিধি অনুযায়ি ঋণ দেয়া হচ্ছে। যাতে প্রতিষ্ঠানগুলো সচল রাখতে পারে। এছাড়া অর্থনৈতিক উন্নয়ন কার্যক্রম ত্বরান্বিত করতে অধিক সংখ্যক গ্রাহককে বিনিয়োগ সুবিধার আওতায় আনতে ঋণ দিচ্ছি। গ্রাহকরা ব্যাংকের প্রাণ। বৃহৎ বিনিয়োগের চেয়ে আমরা ছোট বিনিয়োগে গুরুত্ব দিচ্ছি। এক্ষেত্রে রিটেইলার, এসএমই, কৃষি, গবাদি পশু, মসলা ও মসলাজাতীয় পণ্য, ফলজসহ বেশকিছু আইটেমের ঋণের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। এছাড়া ব্যাংকের প্রত্যেকটি শাখা প্রধানকে গ্রাহক হয়রানির বিষয়ে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। প্রকৃত গ্রাহকরা যেন বিনিয়োগ পেতে কোনোভাবে হয়রানির শিকার না হয় সে ব্যাপারে কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। রেমিট্যান্স গ্রাহকদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতিতে সিএমএসএমই খাতের ভূমিকা অপরিসীম। বর্তমানে দেশের ৯০ শতাংশ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এই খাতের। খাতটি দেশের প্রায় ৮৫ শতাংশ কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সরাসরি ভূমিকা রাখছে। জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন, কর্মসংস্থান তৈরি ও দারিদ্র্য বিমোচনই সিএমএসএমই খাতের মূল লক্ষ্য। দেশের সামগ্রিক জিডিপিতে প্রায় ২৫ শতাংশ অবদান এ খাতের। তাই আমরাও কর্মসংস্থান ও অর্থনীতি উন্নয়নের লক্ষ্যে সিএমএসএসইতে ঋণের পরিমাণ বাড়াবো। এছাড়া আমাদের পরিকল্পনা হলো, ওভারডিও, ক্লাসিফায়েড ও অবলোপনকৃত বিনিয়োগ থেকে আদায়ের কার্যক্রমকে আরো জোরদার করা। চলমান মামলাগুলো গতিশীল করা, স্থগিত হয়ে থাকা মামলাগুলোকে পুনরায় সচল করা। দেশে ব্যাংকিং কার্যক্রমের মাধ্যমে বিভিন্ন অঞ্চলে শিল্প প্রতিষ্ঠান, শ্রমঘন শিল্প প্রতিষ্ঠান, উৎপাদনমুখী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার লক্ষ্যে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছি, পাশাপাশি প্রত্যন্ত অঞ্চল ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনতে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছি।
ঢাকাওয়াচ : খেলাপি ঋণ আদায় নতুন কোনো পরিকল্পনা নিয়েছেন কি?
মো. শওকত আলী খান: ব্যাংক ব্যবস্থায় আস্থার জন্য খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ জরুরি। বিগত ১৬ বছরে আর্থিক খাতে নজিরবিহীন অপশাসনের মাধ্যমে এই খাতকে বিপর্যস্ত করে তোলা হয়েছে। ব্যাপক ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে এবং সেগুলো বারবার পুনঃতফসিল করে প্রকৃত অবস্থা আড়াল করা হয়েছে। তাই তখন খেলাপি ঋণ কম দেখানো হতো। এখন সেগুলো যাছাই-বাচাই করতে গিয়ে ঋণের আসল চেহারা বের হয়ে আসছে। ফলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কিছুটা বাড়ছে। পরিকল্পনা তো অবশ্যই রয়েছে। রিকভারির ক্ষেত্রে আমারা বিভিন্ন ধরনের কমিটি করেছি। এছাড়া যতগুলো টুলস আছে যথাযথ নিয়ম মেনেই তা করছি। এক কথায় বলা যায় আমার ব্যাংকের বর্তমান টিমের একাগ্রতা আর শ্রমই সফলতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমার পুরো টিমকে উজ্জীবিত করতে পেরেছি এবং আমার একটি গোল আছে চেয়ারম্যান মহোদয় সব ধরনের সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। সে কারণেই এত বৈরি পরিবেশের মধ্যেও আমরা ভালো অবস্থানে রয়েছি। সুতরাং আমার চেয়ারম্যান মহোদয় থেকে শুরু করে মাঠ পর্যায়ের সকল সর্মকর্তা, কর্মচারী-সবার অবদান রয়েছে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে খেলাপি ঋণ ১৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে পারবো ইনশাআল্লাহ।
ঢাকাওয়াচ : ব্যাংকের সেবার পরিধি সম্পর্কে জানতে চাই?
মো. শওকত আলী খান: বর্তমানে সোনালী ব্যাংকের দেশব্যাপী শাখা -১২৩৪টি শাখা, বিদেশে শাখা: ২টি শাখা রয়েছে। এটিএম বুথ, এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট, অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট মাধ্যমে অত্যন্ত সুনাম ও আস্থার সাথে গ্রাহকদের ব্যাংকিং সেবা প্রদান করে আসছে। দেশের কৃষি, অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প, তৈরী পোষাক ও অবকাঠামো থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রে সোনালী ব্যাংক বিনিয়োগ সুবিধা প্রদান করে জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বর্তমান সময়ে ব্যাংকিং সেক্টরে গ্রাহক আস্থার সোনালী ব্যাংক পিএলসি। গ্রাহকদের আন্তরিকভাবে সেবা প্রদান, দিন দিন আমানত ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির পাশাপাশি এই ব্যাংকের গ্রাহক সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সোনালী পেমেন্ট গেটওয়ে নামে একটা অ্যাপস রয়েছে। সোনালী ব্যাংক দ্বারা পরিচালিত নিজস্ব পেমেন্ট গেটওয়ে। যার মাধ্যমে ২ হাজারের প্রতিষ্ঠানের মতো বিভিন্ন সরকারি/বেসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিধ ফি নিরাপদে ও দ্রুত সময়ের মধ্যে জমা দেওয়া যায়। সোনালী পেমেন্ট গেটওয়ে যেকোন ধরনের কার্ড, মোবাইল ব্যাংকিং, ইন্টারনেট ব্যাংকিং ইত্যাদি পেমেন্ট পদ্ধতিকে সাপোর্ট করে। এটি সাধারনত বিভিন্ন অনলাইন পেমেন্ট প্রক্রিয়াকে সহজ করে এবং পেমেন্ট গ্রহণের জন্য একটি নির্ভরযোগ্য প্লাটফরম। বৈদেশিক রেমিটেন্স সেবা প্রদানের জন্য দেশের বাহিরে দুটি শাখা রয়েছে। এছাড়া বিশ্বের বিখ্যাত উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রেমিট্যান্স কোম্পানীর সাথে আমাদের চুক্তি রয়েছে, এদের মধ্যে ওয়েস্টার্ণ ইউনিয়ন, মানিগ্রাম, এক্সপ্রেস মানি, রিয়া, ট্রান্সফাস্ট, ন্যাশনাল মানি।