কবিরাজ থেকে কালক্রমে কোটিপতি: বিতর্কে জড়ানো সেই ‘নুরাল পাগলা’র জীবন
- নিউজ ডেস্ক
- প্রকাশঃ ১১:২৪ এম, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫

নুরুল হক মোল্লা, যিনি নুরাল পাগলা নামে পরিচিত, রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের হাতেম মোল্লার ছোট ছেলে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করা নুরাল ১৯৭২ সালে সরকারি উদ্যোগে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেন, তবে তিনি পাস করেছিলেন কি না, তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারেননি। কৈশোর থেকে তিনি মাটির বদনা বাজিয়ে গান করতেন। পেশাগতভাবে কিছু না করলেও ঘুড়ি ও টুপি বানানো এবং কবিরাজি করতেন। তবলা বাজানো ছিল তার শখ। সেসময় তিনি ছনের ঘরে বসবাস করতেন।
বিভিন্ন ইসলামবিরোধী কার্যক্রমের কারণে নুরাল পাগলা জীবদ্দশায় বারবার বিতর্কের কেন্দ্রে ছিলেন। ২৩ আগস্ট তার মৃত্যু হয়। ১৩ দিন পর, ৫ সেপ্টেম্বর শুক্রবার, ক্ষুব্ধ জনতা তার বাড়ি ও দরবারে হামলা চালিয়ে তার লাশ কবর থেকে তুলে আগুন ধরিয়ে দেয়।
এক প্রতিবেশীর ভাষ্যমতে, ৮০ ও ৯০ দশকে কবিরাজি করলেও নুরাল কারও কাছ থেকে অর্থ গ্রহণ করতেন না। কেউ কিছু দিলে সেটা রেখে দিতেন, খাবার হলে তা বাবা-মাকে খাওয়াতেন। পরে সংসারের চাপে অর্থ নেওয়া শুরু করেন এবং নিয়মিত গান-বাজনার আসর আয়োজন করতেন। আশির দশকে নিজেকে ইমাম মাহদী দাবি করে তিনি দরবার গড়ে তোলেন। ধর্মীয় নেতারা এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করলে তিনি এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান। পরে ১৯৯৩ সালের ২৩ মার্চ মুচলেকা দিয়ে ফেরেন, তবে আবারও দরবার চালু করেন।
স্থানীয়দের অভিযোগ, তিনি পবিত্র কুরআনকে ‘ভুজপাতা’ বলে অভিহিত করতেন, কালেমা ও আজানে রাসুল (সা.)-এর নাম বাদ দিয়ে নিজের নাম প্রচার করতেন। নিজেকে সৃষ্টিকর্তা দাবি করে অনুসারীদের সেজদা নিতে বলতেন। মৃত্যুর পর কবর তাওয়াফ করার অসিয়তও করে যান। তার অনুসারীরা এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
নুরালের বড় ভাই সিরাজুল ইসলাম মোল্লা ও দুলাল মোল্লার পরিবারের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল না। বড় ভাইয়ের ছেলে লিটন অভিযোগ করেন, তিনি তাদের জমি জোর করে দখল করে তাদের বাড়ি থেকে বের করে দেন এবং মামলা দিয়ে তাকে জেল খাটান। বাজারে কুলি-মজুরি করলেও ধনাঢ্য চাচা কখনও খোঁজ নেননি।
তবে ৫ সেপ্টেম্বর হামলার সময় প্রতিবেশীরা নুরালের পরিবারের অনেক সদস্য ও ভক্তদের নিরাপদে সরিয়ে নিতে সহায়তা করেন।
নুরুল হক শামসু মহুরি নামে একজন দলিল লেখকের মেয়ে আনোয়ারা খাতুনকে বিয়ে করেন। তাদের দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে, যারা সামাজিক জীবনে বেশ গুটিয়ে থাকেন।
কালের প্রবাহে নুরাল পাগলা বিশাল সম্পদের মালিক হন। তার বাড়ি উঁচু প্রাচীর ঘেরা, যার ভেতরে রয়েছে তিনতলা একটি ভবন ও দুটি ছোট ভবন। আছে দামি গাড়িও। যদিও তার কোনো দৃশ্যমান আয়ের উৎস ছিল না। তবে তার বড় ছেলে মেহেদী নুরতাজ ওরফে নুরতাজ নোভার গার্মেন্ট ব্যবসা রয়েছে বলে জানা গেছে। নুরতাজের বিরুদ্ধে খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের অভিযোগে মামলা রয়েছে এবং অভিযোগ রয়েছে, দরবারের আড়ালে তারা খ্রিষ্ট ধর্মের এজেন্ট হিসেবে কাজ করছিলেন।
ভক্ত রাসেল মোল্লার বাবা আজাদ মোল্লার করা মামলায় বলা হয়েছে, হামলাকারীরা দরবারে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও মারধর করে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকার ক্ষতি করেছে। তারা দরবার থেকে ৪০ লাখ টাকা, ৫০ লাখ টাকার স্বর্ণালংকার এবং ৫৫ লাখ টাকার মালামালসহ মোট ১ কোটি ৪৫ লাখ টাকার সম্পদ লুট করে নেয়।
২৩ আগস্ট সকালে ঢাকার একটি হাসপাতালে বার্ধক্যজনিত কারণে তার মৃত্যু হয়। তাকে মাটি থেকে ১২ ফুট উঁচুতে একটি কাঠামোর ওপর দাফন করা হয়, যা কাবা ঘরের আদলে তৈরি করা হয়েছিল।
এই দাফন প্রক্রিয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে স্থানীয় আলেম ও ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগ তোলেন। তারা উপজেলা ইমাম-আকিদা রক্ষা কমিটি গঠন করে সংবাদ সম্মেলন করেন এবং জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়ে প্রতিকার দাবি করেন। প্রতিকার না পেয়ে ৫ সেপ্টেম্বর বিক্ষোভ ডাকা হয়। সমাবেশ শেষে একদল ব্যক্তি নুরালের বাড়ি ও দরবারে হামলা চালায়।
গোয়ালন্দ ঘাট থানার ওসি রাকিবুল ইসলাম জানান, পুলিশ ও রাসেল মোল্লাকে মারধরের ঘটনায় দায়ের করা দুই মামলায় বুধবার পর্যন্ত ২০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মামলায় মোট আসামির সংখ্যা সাড়ে সাত হাজার। ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে আসামিদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। পাশাপাশি যারা হামলায় উসকানি দিয়েছে, তাদেরও শনাক্ত করে গ্রেপ্তারের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।