সাংবাদিক তুহিন হত্যার চার্জশিট ১৫ দিনের মধ্যে: জিএমপি কমিশনার
- গাজীপুর প্রতিনিধি
- প্রকাশঃ ০৪:৪৬ পিএম, ০৯ আগস্ট ২০২৫

গাজীপুরে সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনকে নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনায় শিগগিরই চার্জশিট দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ (জিএমপি) কমিশনার ড. নাজমুল করিম খান জানিয়েছেন, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন হাতে পেলে পরবর্তী ১৫ দিনের মধ্যেই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করা হবে।
শনিবার (৯ আগস্ট) দুপুরে গাজীপুর মহানগরীর ওয়্যারলেস গেট এলাকায় জিএমপির সদর দপ্তরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ তথ্য জানান।
ঘটনায় পুলিশের দায়িত্ব পালনে ঘাটতির কথা স্বীকার করে জিএমপি কমিশনার বলেন, "সাংবাদিক হত্যার দায় আমরা এড়াতে পারি না৷ আমাদের ব্যর্থতা ও জনবল স্বল্পতা রয়েছে। পুলিশের একার পক্ষে অপরাধ দমন করা সম্ভব হয় না। এখানে জনগণের সম্পৃক্ততা প্রয়োজন।"
তিনি আরও বলেন, নিরাপত্তা নিশ্চিত না করতে পারায় এটি প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়নি। “প্রিভেনশন সব সময় করা যায় না। বিশ্বের কোনো দেশ ক্রাইম একেবারে শূন্যতে নিয়ে আসতে পারেনি। তাই, আমাদের শত চেষ্টার পরেও ক্রাইম হয়ে যেতে পারে। যে ঘটনাটি ঘটেছে, তার জন্য আমরা দুঃখ প্রকাশ করছি।”
ঘটনার পটভূমি তুলে ধরে পুলিশ কমিশনার জানান, ঘটনার শুরু হয় বাদশা মিয়া নামে এক ব্যক্তি স্থানীয় একটি এটিএম বুথ থেকে ২৫ হাজার টাকা তোলার পর। গোলাপি নামের এক নারী তাকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করেন। তবে বিষয়টি আঁচ করতে পেরে বাদশা মিয়া গোলাপিকে ঘুষি মারেন। সিসিটিভি ফুটেজেও এ দৃশ্য রয়েছে।
এরপর গোলাপির সঙ্গে আগে থেকেই অবস্থান নেওয়া তার সহযোগী ৫-৬ জন বাদশা মিয়াকে কুপিয়ে আহত করে। এ সময় পাশেই উপস্থিত সাংবাদিক তুহিন ঘটনাটির ভিডিও ধারণ করছিলেন। তার ভিডিও করতে দেখা মাত্রই হামলাকারীরা বুঝতে পারে, তাদের অপরাধ প্রকাশ পেয়ে যাবে।
“তারপরে আসামিরা সাংবাদিক তুহিনের ভিডিওটি কেড়ে নেওয়ার জন্য তার সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়ায় এবং তাকে ধাওয়া করে। এক পর্যায়ে সাংবাদিক তুহিন একটি চা স্টলে আশ্রয় নিলে তাকে সেখান থেকে ধরে এনে কুপিয়ে হত্যা করা হয়,” বলেন জিএমপি কমিশনার।
তিনি জানান, ঘটনার পরপরই সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে আটজনকে শনাক্ত করা হয়। এর মধ্যে সাতজনকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকি একজনকেও খুব শিগগিরই আটক করা হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
জিএমপি কমিশনার বলেন, সাংবাদিক হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার আসামিরা হলেন, জামালপুরের মেলান্দহ থানার মাহমুদপুর এলাকার মোবারকের ছেলে মিজান ওরফে কেটু মিজান (৩৫), তার স্ত্রী গোলাপী (২৫), পাবনার ফরিদপুর উপজেলার সোনাহারা গ্রামের নূর মোহাম্মদের ছেলে মো. স্বাধীন (২৮), খুলনার সোনাডাঙ্গা উপজেলার ময়লাপোতার হানিফের ছেলে আল আমিন (২১), কুমিল্লার হোমনা থানার আন্তপুর গ্রামের হানিফ ভূঁইয়ার ছেলে শাহজালাল (৩২), পাবনার চাটমোহর থানার পাঁচবাড়ীয়া গ্রামের কিয়ামুদ্দিনের ছেলে মো. ফয়সাল হাসান (২৩) এবং সুমন নামের একজন।
পুলিশ জানায়, এই চক্রের বিরুদ্ধে আগেও একাধিক মামলা রয়েছে। প্রধান অভিযুক্ত কেটু মিজানের নামে ১৫টি মামলা আছে। গোলাপি ‘হানি ট্র্যাপ’ ফাঁদে ফেলার কাজে যুক্ত ছিলেন। অভিযুক্ত আল আমিন, স্বাধীন, শাহজালাল ও ফয়সাল হাসানের বিরুদ্ধেও একাধিক মামলা রয়েছে।
কমিশনার বলেন, “সংঘবদ্ধ চক্রের অপরাধের চিত্র ধারণ করতে গিয়ে জীবন দিয়েছেন সাংবাদিক।” তিনি জানান, পুলিশের হাতে সিসিটিভি ফুটেজ, প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্যসহ সব ধরনের প্রমাণ রয়েছে। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর দ্রুততম সময়ে চার্জশিট দেওয়া হবে।
“আমরা আশা করি দ্রুত তাদের সর্বোচ্চ সাজা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। সাজার সংস্কৃতি নিশ্চিত করা গেলে ক্রাইম দমন করা যাবে। আসামিরা যদি নাও স্বীকার তবে, এভিডেন্সই তাদের অপরাধ প্রমাণ করবে,” বলেন তিনি।
পুলিশের মনোবল নিয়ে প্রশ্নের জবাবে জিএমপি কমিশনার বলেন, ঘটনার পর পুলিশ এখনও মনোবল পুনরুদ্ধার করতে পারেনি। এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। তিনি বলেন, “গাজীপুরে ৫ আগস্টের পর অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। কর্মসংস্থান বন্ধ হয়ে গেলে ক্রাইম বেড়ে যায়। এটা জননিরাপত্তার জন্য হুমকি।”
সাবেক প্রভাবশালী একটি গোষ্ঠীর দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, তারা চায় না গাজীপুরে স্থিতিশীলতা ফিরে আসুক। তাদের তৎপরতা পর্যবেক্ষণে থাকায় অন্যান্য অপরাধ প্রতিরোধেও কিছুটা ব্যাঘাত ঘটছে বলে জানান তিনি।
উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার রাত ৮টার দিকে গাজীপুর মহানগরীর ব্যস্ত চান্দনা চৌরাস্তা এলাকার একটি মার্কেটের ভেতরে সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা করা হয়। তিনি দৈনিক ‘প্রতিদিনের কাগজ’-এর গাজীপুর প্রতিনিধি ছিলেন। ৩৮ বছর বয়সী তুহিন ছিলেন ময়মনসিংহ জেলার ফুলবাড়িয়ার ভাটিপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। তিনি স্ত্রী ও দুই সন্তানসহ গাজীপুরে ভাড়া বাসায় বসবাস করতেন।
ঘটনার পর বাসন থানায় দুটি মামলা দায়ের হয়েছে। একটি দায়ের করেছেন নিহত তুহিনের বড় ভাই মো. সেলিম। অন্যটি বাদশা মিয়াকে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় তার ভাই করেছেন।
সাংবাদিক তুহিনের মরদেহের ময়নাতদন্ত শুক্রবার সকালে গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমেদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে সম্পন্ন হয়। এরপর চান্দনা চৌরাস্তার ঈদগাহ মাঠে জানাজা শেষে ময়মনসিংহে নিজ গ্রামে তার দাফন সম্পন্ন হয়।