রংপুর সমন্বিত শিশু পুনর্বাসন কেন্দ্রে শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের অভিযোগ


saurav/Child_20250616_204922408.webp

রংপুরে সমন্বিত শিশু পুনর্বাসন কেন্দ্র থেকে চার কিশোরী নিখোঁজের ঘটনায় তোলপাড় শুরু হয়েছে জেলাজুড়ে। এ ঘটনায় রোববার (১৫ জুন) পুলিশ দুইজনকে উদ্ধার করলেও এখনও নিখোঁজ রয়েছে ২ কিশোরী। 

উদ্ধার হওয়া কিশোরীরা পুনর্বাসন কেন্দ্রে শিশু-কিশোরীদের শারীরিক-মানসিক ও যৌন নির্যাতনের ভয়াবহ তথ্য দিয়েছে। জীবন বাঁচাতে তারা পুনর্বাসন কেন্দ্র থেকে পালিয়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছে। 

এদিকে নিবাসীদের ভয়-ভীতি প্রদর্শনসহ ঘটনাকে ধামাচাপা দিতে জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে সমাজসেবা কার্যালয়। নিরাপদ আশ্রয় প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের এমন কর্মকাণ্ড সচেতনমহলে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। এ ব্যাপারে মুখ খুলতে নারাজ সমাজসেবা জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক অনিল চন্দ্র বর্মণ। অবিলম্বে এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তসহ দোষীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন মানবাধিকার কর্মীরা। 

জানা যায়, রংপুর নগরীর দেওডোবা ডাংগীরপাড় এলাকায় অবস্থিত ১০০ শয্যাবিশিষ্ট সমন্বিত শিশু পুনর্বাসন কেন্দ্র। বর্তমানে প্রায় ৬৮ জন নিবাসী রয়েছে। হারিয়ে যাওয়া, প্রতিবন্ধী, এতিম ও মামলা সংক্রান্ত কারণে আদালত থেকে পাঠানো শিশু-কিশোরীরা এখানে থাকেন। বৃহস্পতিবার (১২ জুন) রাতে এই কেন্দ্র থেকে নিতু, স্মৃতি, কৃতি ও আশা নামের চার কিশোরী নিখোঁজ হন। সমাজসেবা কার্যালয়ের এ নিয়ে মাথাব্যথা না থাকলেও পরিবারের অভিযোগের প্রেক্ষিতে পুলিশ দু’দিন পর ১৫ জুন স্মৃতি ও কৃতিকে উদ্ধার করে। ওই দিন পুলিশ তাদের আদালতের মাধ্যমে পুনরায় সমন্বিত শিশু পুনর্বাসন কেন্দ্রে (বালিকা) পাঠায়। কিন্তু আদালতের বারান্দায় থাকা স্মৃতির মা নগরীর রবার্টসনগঞ্জের বাসিন্দা মুক্তি বেগম মেয়েকে পুনর্বাসন কেন্দ্রে পাঠাতে পুলিশের কাছে আপত্তি জানায়। 

এসময় স্মৃতির মা’র কাছে আপত্তির কারণ জানতে চাইলে তিনি পুনর্বাসন কেন্দ্রে মেয়ের ওপর নির্যাতন ও তার জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন। এসময় তিনি তার মেয়েকে পুনর্বাসন কেন্দ্রে নয় থানার ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে রাখার জন্য পুলিশের কাছে আবেদন করেন। আদালতের আদেশ ছাড়া এটি সম্ভব নয় বলে পুলিশ জানায়। 

মুক্তি বেগম জানান, পুনর্বাসন কেন্দ্রে নিবাসীদের শারীরিক-মানসিক নির্যাতন করা হয়। রাতের বেলা পুরুষদের আসা-যাওয়াসহ নানা অনিয়ম চলে কেন্দ্রটিতে। এছাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্র থেকে স্মৃতি নিখোঁজ হলে থানায় মুক্তি বেগম সাধারণ ডায়েরি করতে চান। কিন্তু ঘটনাকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য থানায় জিডি করতে বাধা দেন সমাজসেবা কর্মকর্তারা বলে উল্লেখ করেন তিনি। 

পরবর্তীতে তিনি থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। এরপর স্মৃতিকে খুঁজে পাওয়ার পর তাকে বাড়ি নিয়ে যেতে চাইলে বাধা দেন পুনর্বাসন কেন্দ্রের দায়িত্বরতরা। 

পুনর্বাসন কেন্দ্র থেকে পালিয়ে যাওয়া নিবাসী স্মৃতি (১৭) বলেন, পুনর্বাসন কেন্দ্রে আমাদের নানা ধরনের শারীরিক-মানসিক ও যৌন নির্যাতন করে। প্রতি রোববার একজন পুরুষ এসে পুনর্বাসন কেন্দ্রের মেয়েদের শরীরের বিভিন্ন স্থানে হাত দেওয়ার চেষ্টা করে। এরিমধ্যে এক মেয়ে গর্ভবতী হয়ে পড়ে। তাকে এখন কেন্দ্রে দেখা যাচ্ছে না বলে জানান স্মৃতি। 

এসবের বিষয়ে প্রতিবাদ জানালে গালি-গালাজ করে উল্লেখ করে এই ভুক্তভোগী জানান, আদালত আমার মঙ্গলের জন্য পুনর্বাসন কেন্দ্রে রেখেছিল, কিন্তু সেখানকার অবস্থা দেখে জীবন বাঁচাতে পালিয়ে গেছি কেন্দ্রের আশা ও মীম নামের দুই কিশোরীও শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এছাড়া অনেক মেয়েরা নির্যাতনের শিকার হয়ে পুনর্বাসন কেন্দ্রে থাকতে চান না, প্রায় সময় কান্নাকাটি করে বলে জানান তিনি। 

রোববার (১৫ জুন) বিকেলে রংপুর আদালতে স্মৃতির সঙ্গে সাংবাদিকদের আলাপচারিতা চলাকালে পুনর্বাসন কেন্দ্রের দায়িত্বরত এক নারী অপর মেয়ে কৃতি টেনে নিয়ে দ্রুত আদালতপাড়া ত্যাগ করার চেষ্টা করেন। এ সময় গণমাধ্যমকর্মীরা কিশোরীকে কেন জোরপূর্বক নিয়ে যাচ্ছেন এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি কিছু বলতে পারবেন না বলে জানান। অনেক চেষ্টা করেও পুনর্বাসন কেন্দ্রের নিবাসী কৃতির নির্যাতনের বিষয়ে কোন বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়ে উঠেনি। 

সমন্বিত শিশু পুনর্বাসন কেন্দ্রে (বালিকা) সরেজমিনে পরিদর্শনের জন্য গণমাধ্যমকর্মীর পরিচয় দিলেও কেন্দ্রটির কর্তব্যরতরা গেট খুলতে বিলম্ব করেন। পরবর্তীতে গেট খুললে গণমাধ্যমকর্মীরা নিবাসীদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেন। এক নিবাসী জানান বৃহস্পতিবার (১২ জুন) চার কিশোরী এ কেন্দ্র থেকে পালিয়ে গেছে। 

দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রথমে অপরাগতা প্রকাশ করলেও পরবর্তীতে সাংবাদিকদের চাপের মুখে চার কিশোরী পালিয়ে যাওয়ার কথা স্বীকার করেন তারা।  

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী বলেন, কঠোর নিরাপত্তার মধ্যেও এমন দু-একটা ঘটনা ঘটে যায়। তবে ভবিষ্যতে যেন এমনটি না হয় সেদিকে বিশেষ নজর দেওয়া হচ্ছে। এটি পুনর্বাসন কেন্দ্র, শিশু-কিশোরী সং-শোধনাগার না। যার কারণে অনেক সময় অনাকাঙ্ক্ষিত এসব দুর্ঘটনা ঘটে যায়। 

তিনি আরও জানান, ২০২৫ সালে পুনর্বাসন কেন্দ্রে ৪ শিশু নিহত হয়। এসময় একজনের ময়না তদন্ত করা হলেও বাকীদের ময়না তদন্ত ছাড়াই দাফন করা হয়েছে। 

এ ব্যাপারে রোববার (১৬ জুন) রংপুর জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক অনিল চন্দ্র বর্মণের সাক্ষাতকার নিতে তার কার্যালয়ে গেলে এ বিষয়ে কোন কথা বলতে চান না বলে জানিয়ে দেন। 

রংপুরের মানবাধিকার ও পরিবেশ সংগঠনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এএএম মুনীর চৌধুরী বলেন, যে শিশু-কিশোরীদের নিরাপদ আশ্রয় দেওয়া ও দেখভালের দায়িত্ব রাষ্ট্র নিয়েছে তাদের মধ্যে কেউ যদি হারিয়ে যায়, নিরুদ্দেশ হয়, নির্যাতনের শিকারের অভিযোগ করে তাহলে তা উদ্বিগ্নের বিষয়। যার ওপর দায়িত্ব রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। সমাজসেবা কর্মকর্তা গণমাধ্যমের সামনে কথা না বললে তার বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা রয়েছে বলে প্রমাণিত হয়। কারণ তার সৎ সাহস নেই অভিযোগের বিষয়টি প্রকাশ করা। 

তিনি অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দ্রুত তদন্তসহ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ এবং নিবাসীদের রক্ষা করতে সমাজসেবা অধিদপ্তর, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও প্রধান উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।

ঢাকাওয়াচ২৪ এর খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন ।
ঢাকাওয়াচ২৪ডটকমে লিখতে পারেন আপনিও ফিচার, তথ্যপ্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, ভ্রমণ ও কৃষি বিষয়ে। আপনার তোলা ছবিও পাঠাতে পারেন [email protected] ঠিকানায়।
×