
চট্টগ্রামের এক শীর্ষ সন্ত্রাসী মো. রায়হান আলম ক্রমশ পুলিশের নজর এড়িয়ে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে হত্যা হুমকি দিচ্ছেন। ব্যবসায়ী হোক বা প্রতিপক্ষ, পুলিশকে হুমকি হোক, রায়হানের কাছে হত্যার হুমকি যেন একটি নিয়মিত কার্যক্রমে পরিণত হয়েছে। অনলাইনে ফেসবুকের মাধ্যমে কিংবা সরাসরি ফোনে তিনি একের পর এক মানুষকে প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছেন, তবুও তাকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়নি পুলিশ।
গত ৫ থেকে ১৩ নভেম্বরের মধ্যে রায়হান তার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট এবং ফোনের মাধ্যমে একাধিকবার হুমকি প্রদান করেছেন। পলাতক অবস্থাতেও তিনি ‘ভয়ঙ্কর মৃত্যু’, ‘খেলা শুরু হবে’, ‘টাকার কারিশমায় মামলা’ ইত্যাদি ভাষায় প্রতিপক্ষকে ভয় দেখাচ্ছেন। পুলিশ জানিয়েছে, তাকে ধরার জন্য তৎপর রয়েছে।
সর্বশেষ গত শুক্রবার রাতে চট্টগ্রামের এক ব্যবসায়ী মো. একরামকে ফোন করে রায়হান হত্যার হুমকি দেন। তিনি বলেন, ‘তোকে গুলি করে মারবো না, ব্লেড দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারবো।’ একরাম, যিনি পাথরের ব্যবসা করেন, জানান, ‘শুক্রবার রাত ৮টার দিকে আমাকে ফোন করে সন্ত্রাসী রায়হান। পরে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো খুদে বার্তায় আমাকে ব্লেড দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারার হুমকি দেয়। এরপর থেকে আতঙ্কে রয়েছি।’
হুমকির কারণ জানতে চাইলে একরাম বলেন, ‘গত ১৫ মার্চ ঢাকার একটি শপিংমলে ঘুরতে দেখে চট্টগ্রামের শীর্ষ সন্ত্রাসী সাজ্জাদ হোসেন ওরফে ছোট সাজ্জাদকে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছিলাম। এরপর সাজ্জাদের স্ত্রী তামান্না শারমিন এবং বিদেশে পলাতক সাজ্জাদ আলী ওরফে বড় সাজ্জাদ আমাকে হুমকি দেয়। ওই হুমকির ঘটনায় পাঁচলাইশ থানায় মামলা করেছিলাম। এরপর থেকে মামলা তুলে নিতে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। নতুন করে হুমকির বিষয়ে থানায় মামলা করবো।’
একরামের স্ত্রী রুমা আক্তার জানান, ‘হুমকির পর থেকে আতঙ্কে আছি। ভয়ে স্বামী বাসা থেকে বের হচ্ছেন না। বের হলে সঙ্গে পুলিশ থাকবে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রামের পুলিশ কমিশনার।’
পাঁচলাইশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ সোলাইমান বলেন, ‘সন্ত্রাসী রায়হানের হুমকির বিষয়ে অবগত আছি আমরা। ওই ব্যবসায়ী মামলা করবেন। এর আগেও হুমকির ঘটনায় ওই ব্যবসায়ী থানায় মামলা করেছিলেন। পুলিশের পক্ষ থেকে তাকে নিরাপত্তা দেওয়া হবে।’
নগর পুলিশের সহকারী কমিশনার (গণমাধ্যম) আমিনুর রশিদ জানান, ‘নগর ও জেলার বেশ কয়েকটি হত্যা মামলায় সন্ত্রাসী রায়হানের নাম উঠে এসেছে। তাকে গ্রেফতারে পুলিশের একাধিক দল কাজ করছে। একেক সময় একেক স্থান থেকে হুমকি দিচ্ছে, এজন্য তাকে গ্রেফতারে সময় লাগছে পুলিশের।’
রায়হানের সঙ্গে হত্যার সম্পর্ক
৫ নভেম্বর চট্টগ্রাম-৮ আসনে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী এরশাদ উল্লাহর নির্বাচনি জনসংযোগে অংশ নেওয়া সন্ত্রাসী সরোয়ার হোসেন বাবলাকে (৪৩) গুলি করে হত্যা করা হয়। তিন দিন আগে সরোয়ারকে ফোন করে হত্যার হুমকি দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে রায়হানের বিরুদ্ধে। নিহত সরোয়ারের বাবা জানান, ‘তোর সময় শেষ, যা খাওয়ার খেয়ে নে।’
২৫ অক্টোবর রাউজান পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডে মোটরসাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফেরার সময় যুবদল কর্মী আলমগীর আলমকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এই হত্যা মামলায় রায়হানকে আসামি করা হয়। পুলিশ জানায়, রাজনৈতিক এই হত্যাকাণ্ডে রায়হান ভাড়াটে খুনি হিসেবে কাজ করেছে।
ছোট সাজ্জাদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নেওয়া রায়হান
পুলিশ জানায়, গত বছরের ৫ আগস্টে কারাগারে চট্টগ্রামের আলোচিত সন্ত্রাসী ছোট সাজ্জাদের সঙ্গে পরিচয় হয় রায়হানের। জামিনে মুক্তির পর রায়হান ছোট সাজ্জাদের সঙ্গে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। সাজ্জাদ সম্প্রতি কারাগারে গেলে রায়হান তার অস্ত্রভান্ডারের দেখভাল করছে। রাউজান ও ফটিকছড়ির পাহাড়ি এলাকায় তার আস্তানা, যেখান থেকে দ্রুত অপরাধ করে নিরাপদ স্থানে চলে যায়। মূলত ছোট সাজ্জাদের কাছ থেকে দীক্ষা নিয়ে রায়হান দুর্ধর্ষ হয়ে উঠেছে।
ফোন ও ফেসবুকে হুমকি
২৫ জুলাই রায়হান নগরের কালুরঘাট এলাকার এক ওষুধের দোকানিকেও হুমকি দিয়েছেন। ১ আগস্ট চান্দগাঁও থানার মোহরা এলাকার ব্যবসায়ীকেও তিনি গুলি করার হুমকি দেন। ফেসবুকেও এক পোস্টে তিনি লিখেছিলেন, ‘রাউজানের হরিশখান পাড়ার আজিজ বস নামের মুনাফিকের যত দালাল আছে, তার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে ইত্যাদির নাম-ঠিকানা লিখে আমাকে ইনবক্স করুন। পরিচয় গোপন রাখা হবে। বাকিটা আমি দেখে নেবো। আমাকে মারার জন্য ২০ লাখ বাজেট করেছে আজিজ। আমি ৩০ লাখ দেবো, আজিজকে জীবিত দিলেই হবে।’
হুমকিপ্রাপ্ত ব্যক্তি আজিজ উদ্দিন ইমু। তিনি চট্টগ্রাম-৬ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরীর ঘনিষ্ঠজন। রায়হান একসময় আজিজের শিষ্য হিসেবে কাজ করলেও পরে স্বাধীনভাবে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে।
২৯ অক্টোবর রাউজান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনিরুল ইসলাম ভূঁইয়াকে উদ্দেশ্যে করে রায়হান ফেসবুকে লিখেছিলেন, ‘আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, মামলা বাণিজ্য বন্ধ করুন। আপনি যদি সঠিক তদন্ত না করে টাকার বিনিময়ে মামলা দিয়ে দেন, রাউজানের পরিস্থিতি কিন্তু আপনার কন্ট্রোলের বাইরে চলে যাবে। যা আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না। বরাবর, ওসি মনিরুল ইসলাম স্যার।’
ওসি মনিরুল ইসলাম ভূঁইয়া জানান, ‘রায়হানের বিষয়টি আমাদের নজরদারিতে আছে। তাকে গ্রেফতারের জন্য খুঁজছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।’
কে এই রায়হান?
রাউজানের ৭ নম্বর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের জুরুরকুল খলিফা বাড়ির মৃত বদিউল আলমের ছেলে রায়হান। পুলিশ বলছে, তিনি ছোট সাজ্জাদের অন্যতম সহযোগী। সাজ্জাদের বাহিনীতে ২৫ জন সক্রিয় সদস্য আছে এবং রায়হান তাদের মধ্যে অন্যতম। ক্ষমতার পরিবর্তনের আগে আওয়ামী লীগের সভা-সমাবেশে অংশ নিতেন, পরে বিএনপির রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেও যুক্ত হন।
চট্টগ্রাম জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কাজী তারেক আজিজ বলেন, ‘রায়হান দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী। তাকে ধরার জন্য সব ধরনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি আমরা।’