
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ১৯ জুলাই যাত্রাবাড়ীতে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের নির্যাতনের পর গুলিতে নিহত হন কারখানা শ্রমিক মো. মেহেদী হাসান। খবর পাওয়ার পর হাসপাতালে হাসপাতালে ছুটে বেরিয়েছেন মা পারভীন আক্তার। কিন্তু ছেলের মরদেহ পাননি। শেষমেশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের মর্গে মেলে ছেলের মরদেহ। পরে সে মরদেহ পেতেও ভোগান্তিতে পড়তে হয় অসুস্থ মাকে। ৬ মাস অতিবাহিত হলেও ছেলে হত্যার বিচারের জন্য একাধিকবার যাত্রাবাড়ী থানায় গেছেন মা পারভীন আক্তার, কিন্তু মামলা নেয়নি পুলিশ।
রোববার (২ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে থানায় মামলা নথিভুক্তসহ তিন দফা দাবিতে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিয়নের (ডিআরইউ) সাগর-রুনি মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন নিহত মেহেদীর মা পারভীন আক্তার।
পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলেকে হারিয়ে দিশেহারা মেহেদীর পরিবার। সংবাদ সম্মেলন ডেকে জুলাই বিপ্লবে ছেলে হারানো মা পারভীন আক্তার বলেন, ‘আমি ছেলে হত্যার বিচার চাই, জড়িত আওয়ামী লীগ ও পুলিশ সদস্যদের বিচার চাই।’
পারভীন আক্তার বলেন, ‘১০ বছর ধরে আমার ছেলে মেহেদী কারখানায় কাজ করে। ওর উপার্জনেই চলছিল পরিবার। আমি অসুস্থ, ওর বাবাও অসুস্থ। গত ১৯ জুলাই মেহেদীকে ঘরে তালা দিয়ে আটকে রেখেছিল। কিন্তু মেহেদী বলে, তরুণ-যুবকরা জীবন দিতাছে, আর আমারে ঘরে আটকে রাখবা? আন্দোলনে যাবার জন্য দরজা ভাঙ্গার হুমকি দিলে দরজা খুলে দিই। মেহেদী গোসল, ভাত খেয়ে আন্দোলনে চলে যায়। একটু পরই খবর পাই মেহেদীর শরীরে গুলি লাগছে। এরপর ছুটে যাই। পাগলের মতো হাসপাতালে হাসপাতালে ছুটতে থাকি। কিন্তু কোথাও মেহেদীর দেখা পাচ্ছিলাম না।’
তিনি আরো বলেন, ‘সবাইরে কইতেছিলাম, আমার ছেলেকে একটু দেখান। আমি সারাদিন কান্দি, কিন্তু ছেলের দেখা নাই। ছেলের মুখ দেখার জন্য লোকজনের খবরে ঢাকা মেডিকেলে যাই। সেখানে পুলিশ, হাসপাতালের লোকজন বলে এখানেও লাশ নাই। অনেক অনুরোধ করে লাশ রাখা ফ্রিজ খুলে দেখানো হলে আমি মেহেদীর দেখা পাই। মরছে আগের দিন আর পরদিন রাত পর্যন্ত ছেলের লাশ নিখোঁজ রাখা হয়। লাশ পেলেও শরীরে পচন ধরে, ময়না তদন্ত শেষ করে লাশ নিয়ে যাই।’
‘আমার বুকটা খালি হয়ে গেছে, যে বা যারা করছে তাদের কিচ্ছুই হয় নাই। হবে কেমনে? মামলাই তো নেয় নাই পুলিশ। আমার কষ্টের জীবন। মেহেদীই আমার দিকে খেয়াল লাখতো। মাসে মাসে ওষুধ লাগে, খানা-দানা কে দিবো? ছেলে মরার পর আজকে জিগানের মতো কেউ নাই, জমি-জমা একছিটেও নাই যে কিছু করে করে খামু।’
শেখ হাসিনার যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি নিশ্চিতের দাবি জানিয়ে পারভীন আক্তার বলেন, ‘সবাই কয় শেখ হাসিনা দেশে আসলে ফাঁসি হবে। আমি হাসিনার বিচার চাই। হাসিনার ফাঁসি দিলে তো বিচার হলো না, দেশে আইনা পাড়ায়া পাড়ায়া, ইটপাটকেল মাইরা যন্ত্রণা দিয়ে মারতে হবে, যেন মেহেদীর মতো মৃত্যু যন্ত্রণাটা বুঝতে পারে।’
পুলিশ ও আওয়ামী লীগের যারা যারা জড়িত তাদের গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত আইনজীবী জাকিউল্লাহ বাহার তিন দফা দাবি জানান। এগুলো হল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ১৯ জুলাই পারভীন আক্তারের বড় ছেলে মেহেদী হাসান হত্যা মামলার এজাহারটি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যাত্রাবাড়ী থানায় এফআইআর হিসেবে নিতে হবে। এবং প্রকৃত ৬জন আওয়ামী লীগের গণহত্যাকারীকে গ্রেপ্তার করতে হবে; ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ২৭ জুলাই দায়েরকৃত যাত্রাবাড়ী থানা মামলা নম্বর -৮১ (জিআর নম্বর ১৭৩২)’-এর শতভাগ মিথ্যা ফাইনাল (চূড়ান্ত) রিপোর্ট (এফআরটি) নম্বর ১০০ (২৮ অক্টোবর ২০২৪) প্রত্যাহার করতে হবে এবং পুনরায় সরেজমিনে দ্রুত সরেজমিনে পুনঃতদন্ত করে ও তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রকৃত গুলিবর্ষণকারী ও গণহত্যাকারী পুলিশ ও আওয়ামী লীগের হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে সঠিক চার্জশিট আদালতে জমা দিতে হবে এবং জড়িত আসামিদের গ্রেপ্তার করতে হবে এবং ১৬ জুলাই হতে ৫ আগস্টে বৈষম্যবিরোধী সব বিপ্লবী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ১৬ বছরের ফ্যাসিস্ট গণহত্যাকারী হাসিনা সরকারের পতন হয়। বর্তমান রাষ্ট্রপতি আদেশমূলে এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বৈষম্যবিরোধী সব বিপ্লবী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের স্বীকৃতি দিতে হবে।
জাকিউল্লাহ বাহার বলেন, ‘গত ১৬ জুলাই হতে ৫ আগস্টের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহত ও আহত বিপ্লবী ছাত্র-জনতার রক্তে গড়া ড. ইউনুসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। আপনারা ক্ষমতায় আছেন বৈষম্যবিরোধী কাজের জন্য। কিন্তু বাস্তবে বৈষম্যের কাজ আপনারাই করছেন। ১৬ বছরের আওয়ামীপন্থি সুবিধাভোগী পুলিশদের বেছে বেছে বাদ দিন এবং সব বৈষম্য দূর করুন। তাহলেই পুলিশের মনোবল বাড়বে।’
বক্তারা আরও বলেন, ‘আন্দোলনে পুলিশ বাহিনী হাজার হাজার রাউন্ড গুলি দিয়ে প্রকাশ্যে গণহত্যা করেছে। বর্তমান আইজিপি সাহেব প্রেস-কনফারেন্স করে বলেছেন, বিএনপি-জামায়াত মামলা বাণিজ্য করছে কিন্তু বাস্তবে পুলিশরাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার ওপর গুলিবর্ষণ ও গণহত্যা মামলাগুলির তদন্ত করবে আর তদন্ত করে মামলা থেকে আসামিদের নাম বাদ দিবে।’
বিএনপি-জামায়াত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার ওপর গুলিবর্ষণ ও গণহত্যা মামলাগুলির তদন্ত করবে না বা মামলাগুলির তদন্ত করে আসামিদের নাম বাদ দিতে পারবে না। গণহত্যা মামলাগুলির ফাইনাল-চার্জশিট সব ক্ষমতাই পুলিশের হাতে। বর্তমান পুলিশরাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার ওপর গুলিবর্ষণ ও গণহত্যা মামলাগুলির তদন্তের নামে আসামিদের ভয়ভীতি দেখিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের নেতাকর্মীদের কাছ থেকে টাকা নিচ্ছে আর মামলার বাদীকে অ্যাফিডেভিট করে আদালতে জমা দিতে বলছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের ৫ মাসের অধিক সময় হয়ে গেছে, কিন্তু বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী এই ৫ মাসে প্রকৃত গুলিবর্ষণকারী ও গণহত্যাকারী পুলিশ ও আওয়ামী লীগ সরকারের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পত্র বা চার্জশিট আদালতে জমা দেয়নি। এই ব্যর্থতার দায় ছাত্র-জনতার ওপর বর্তায় না। বর্তমান আইজিপি সাহেব বিএনপি-জামায়াত মামলা বাণিজ্য করছে আপনার একতরফা অভিযোগটি প্রেস-কনফারেন্স করে প্রত্যাহার করুন।