
দেশে দুর্নীতির মাশুল এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, সমাজ যদি আজও সেটিকে গলায় «টিপে» ধরতে না পারে তাহলে বেঁচে থাকবে শুধুই নামমাত্র সমজোরূপে; এমন চিন্তা ব্যক্ত করেছেন জামায়াতে ইসলামী-এর আমির শফিকুর রহমান। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘‘এই সমাজ বেঁচে থাকলে একটা ক্ষণভঙ্গুর সমাজ হিসেবে বেঁচে থাকবে। এরকম সমাজ তো কোনো দেশের নাগরিক কামনা করে না।’’
যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফেরার পথে যুক্তরাজ্যে এক দিনের যাত্রাবিরতির সময় শুক্রবার (৩১ অক্টোবর) লন্ডনের একটি হোটেলে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন তিনি।
গত বছরগুলোতে দেশের সর্বস্তরে দুর্নীতির বিস্তার নিয়ে কথা বলতে গিয়ে জামায়াত আমির দেশীয় অবস্থা ও পাকিস্তান আমলকে তুলনায় আনেন। তিনি বলেন, ‘‘বিষয়টা এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, পাকিস্তান আমলে আমরা নিভুনিভু জ্ঞান বুদ্ধি ছিল। তখন কোনো জায়গায় কোনো ঘুষখোর অফিসার আসলে সারা জেলা জেনে যেত যে এই অফিসারটা ঘুষখোর। আর এখন যদি কোনো সৎ অফিসার আসে, সবাই বলে যে এই একটা মানুষ সৎ। দেখেন অবস্থাটা কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে।’’
তিনি আরও বলেন, ‘‘একেবারে পুরা রিভার্স হয়ে গেছে। এটা খুবই দুঃখজনক। যেই সমাজে দুর্নীতি অনুসঙ্গ হয়ে যায়, নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে যায়, এই সমাজ তারা মাজা সোজা করে দাঁড়াতে পারে না, মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারে না।’’
শিক্ষা ব্যবস্থার ধ্বংসও তুলে ধরেন তিনি। ‘‘আমাদের শিক্ষাটাও বিধ্বস্ত। আমাদের সেখানে দুর্নীতির ছয়লাব। কোনো জায়গায় নাই সুবিচার। যেখানেই যাবে মানুষ পায় অবিচার। এই অবস্থায় এই দেশ এবং জাতিকে কেউ আর দেখতে চায় না। আমরাও দেখতে চাই না। আপনারাও নিশ্চয়ই দেখতে চান না।’’
জুলাই মাসের অভ্যুত্থানের পর দেশে যে পরিবর্তন এসেছে, সে প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, ‘‘এই যে পরিবর্তনটা হলো, কীসের প্রত্যাশায়? একটাই প্রত্যাশা যে সমাজে কোনো অনিয়ম এবং বৈষম্য থাকবে না। আর সকল অনিয়ম এবং বৈষম্যের মূলে হচ্ছে দুর্নীতি। সমাজের সব জায়গায় দুর্নীতিবাজরা বসে থাকার কারণে সমাজে মানুষের যে ন্যায্য অধিকার, এটা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। প্রত্যেকটি মানুষ নিগৃহীত।’’
আসন্ন নির্বাচনে প্রবাসীদেরও ভোটাধিকার প্রসঙ্গে জামায়াত আমির বলেন, ‘‘আপনার কী লাগবে? বার্থ সার্টিফিকেট। কী লাগবে? ইউটিলিটি বিল। আরে, লোকটা তার মানে বছর বছর যুগ যুগ ধরে যে লোকটা এখানে বসবাস করছে, গ্রামে হয়ত আপাতত তার কোনো ঘরবাড়ি নাই। ইউটিলিটি বিল কীসের? তার ওখানে কারেন্ট জ্বলেনা না কারেন্টের বিল সে দিবে? বিল সে দেখাবে? ওই সুযোগই নাই অনেকের। সেটাও দিতে হবে। বার্থ সার্টিফিকেট আনতে গেলে যে ঢাকা থেকে আনবেন, সে আগে হাত পাতে ভিক্ষুকের মত বসে যে ‘আমাকে কিছু দেন আগে’। না দিলে ঘুরায়। বিভিন্ন ঝামেলা সৃষ্টি করে। ওইটা কী, এইটা কী? হাজার সমস্যা সৃষ্টি করে।’’
তিনি বলেন, বিরোধী দলে থাকা ব্যক্তিরাও দেশের মানুষের জন্য কিছু করতে পারে, তবে ‘‘সীমিত’’ পরিসরে। আর দায়িত্ব নেওয়ার সুযোগ পাওয়া যারা; তাদের জন্য ‘‘অবারিত দ্বার খুলে যায়’’। ‘‘যদি সেই মানুষগুলো দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন হয়, যদি তাদের অ্যাকাউন্টেবিলিটি থাকে, দায়বদ্ধতা থাকে সমাজের কাছে, নিজের বিবেকের কাছে, তাহলে তাদের কাছ থেকে সার্ভিস ডেলিভারি হয় ওয়ান্ডারফুল। কিন্তু দায়বদ্ধতা যদি না থাকে, আল্লাহর ভয় যদি না থাকে, দেশের প্রতি ভালোবাসা যদি না থাকে, তাহলে প্রত্যেকটা মানুষ সকল মানুষের পকেট কেটে সে শুধু নিজে বড়লোক হতে চায়। এটাই আমরা দুঃখজনকভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দীর্ঘ সময় ধরে প্রত্যক্ষ করে আসছি।’’
সবাইকে একসঙ্গে এমন পরিস্থিতি বদলানোর আহ্বান দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘আপনাদের প্রতি আমাদের অনুরোধ যে আমাদেরকে যতক্ষণ ভালো কাজের উপরে দেখবেন, একটু ভালোবাসা আপনাদের আমরা চাইব। একটু সহযোগিতা চাইব। পাশাপাশি আমাদের যে কাজটা আপনাদের বিবেকের কাছে সঠিক বলে মনে হবে না, সেই জায়গায় আপনাদের সমালোচনাটাও আমরা চাইব। ভালোবাসা, সহযোগিতা মানুষকে এগিয়ে দেয়, কিন্তু সমালোচনা তার চেয়ে বেশি এগিয়ে দেয়।’’
প্রবাসীদের আগামী নির্বাচনে ভোট দেওয়ার বিষয়েও তিনি বলেন, ‘‘ভোটের অধিকার, আমি বলি যে এটা ভেটো পাওয়ার। এটা যদি আপনার হাতে থাকে, অনেক অধিকার আপনার কাছে চলে আসবে। আর এটা যদি আপনার হাতছাড়া থাকে, তাহলে লোক ওয়ান ওয়েতে শুধু আপনার কাছ থেকে নিতে চাইবে, আপনাকে আপনার পাওনাটা দিতে চাইবে না।’’ প্রবাসীদের ভোটার হওয়ার জন্য নিবন্ধনের সময় আরও ১৫ দিন বাড়ানোর জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের পর উপস্থিত সাংবাদিকদের কয়েকটি প্রশ্নেরও জবাব দেন জামায়াত আমির। একটি প্রশ্ন ছিল, মামলায় যে সেনা কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, জামায়াত শাসনায় তাঁদের বিচার অব্যাহত থাকবে কি না। তিনি বলেন, ‘‘আমরা এটা চাই না কারো উপর অবিচার হোক, কিন্তু অপরাধ হলে তার ন্যায্যবিচার পাওয়ার অধিকার ভিকটিমের অবশ্যই আছে। আমরা এই দৃষ্টিকোণ থেকে সকল অবিচারের বিরুদ্ধে ন্যায্যবিচারকে আমরা সমর্থন করি। আর আমাদের পাঁচটা প্রায়োরিটি ও অঙ্গীকারের মধ্যে একটা হচ্ছে সমাজে সর্বস্তরে ন্যায্যবিচার কায়েম করা। সুতরাং ন্যায়বিচার কায়েম করলে আগামীতে যারা অবশ্যই বিচার প্রার্থী হবেন, তারা তাদের ন্যায়বিচার পাবেন, তারা বঞ্চিত হবেন না ইনশাআল্লাহ।’’
সরকারি অফিস থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং জিয়াউর রহমান-এর ছবি অপসারণ নিয়ে এক জামায়াত নেতার সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়ানো ফটোকার্ড ‘মিথ্যা’ বলেই জানান তিনি। সংবিধানে বা জুলাই সনদের মধ্যে জিয়াউর রহমানের নাম বা ছবি থাকার প্রশ্নে বলেন, ‘‘আপনি ভালো করে জুলাই… জুলাই সনদ পড়েন। তাকে… সব ব্যাপারে সবাইকে বলা যায় ভাই? সবাইকে তো কিছু কিছু অংশ দিতে হবে যার যেটা পাওনা। যেমন ধরেন জেনারেল ওসমানী, উনি মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছেন। আজকে তাকে কেউ স্মরণ করে? স্বীকার করে? তাকে স্বীকার করা উচিত না? আসম আব্দুর রাব প্রথম পতাকা তুলে ধরেছে, তাকে কেউ স্মরণ করে? স্বীকার করে? তার একটা রিকগনিশন পাওয়া উচিত না? আমাদের অনেক কিছুই অনেক কিছুকে রিকগনাইজ করে না। আল্লাহ যদি আমাদেরকে সুযোগ দেন, যার যেখানে যে অবদান আছে, আমরা কোনো কিছুর উপর অবিচার করবো না ইনশাআল্লাহ।’’
এক সাংবাদিক দলের ইশতেহার সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে ইশতেহারের কিছুই তারা প্রকাশ করবেন না। তবে কোনো ‘মিথ্যা আশ্বাস’ তারা জাতিকে দেবেন না।’’
গণভোট নিয়ে প্রশ্নে তিনি জানান, ‘‘আমাদের স্ট্যান্ড ভেরি ক্লিয়ার। গণভোট আগে হতে হবে, নইলে এটা মূল্যহীন। এটার কোনো দুই পয়সার মূল্য নাই।’’
সর্বশেষ, একজন সাংবাদিক জানতে চান যে যুক্তরাষ্ট্র সফরে মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কি ইতিবাচক আলোচনা হয়েছে কি না? তিনি জবাব দেন, ‘‘জি, আলহামদুলিল্লাহ। অনেক জায়গায় অনেক ওনাদের সাথে কথা হয়েছে। সেটা কোনো দলের জন্য বলি নাই, এটা দেশের জন্য বলেছি। যা ভালো মনে করেছি। আলহামদুলিল্লাহ। এবং তাদেরকে সম্মান দিয়ে বলেছি। আমরাও দুনিয়ার সবার কাছে একটু সম্মান চাই। আর এই সম্মান আমরা পেতে পারি।’’
এই সময় যুক্তরাজ্যে জামায়াতের মুখপাত্র বেয়ারিস্টার আবু বকর মোল্লাহ এবং বেয়ারিস্টার নজরুল ইসলাম-ও উপস্থিত ছিলেন।
ঢাকাওয়াচ২৪ডটকমে লিখতে পারেন আপনিও ফিচার, তথ্যপ্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, ভ্রমণ ও কৃষি বিষয়ে। আপনার তোলা ছবিও পাঠাতে পারেন[email protected]ঠিকানায়।
ঢাকাওয়াচ২৪ডটকমে লিখতে পারেন আপনিও ফিচার, তথ্যপ্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, ভ্রমণ ও কৃষি বিষয়ে। আপনার তোলা ছবিও পাঠাতে পারেন[email protected]ঠিকানায়।