.png)
চব্বিশের জুলাই-আগস্টের আন্দোলন ঘিরে হত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে করা একাধিক মামলায় বর্তমানে কারাগারে আছেন ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় দায়িত্ব পালন করা বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা। তাদের মধ্যে মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার স্বীকৃতি পাওয়া অন্তত ২৩ জন বীর মুক্তিযোদ্ধাও রয়েছেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালসহ বিভিন্ন আদালতে এসব মামলার বিচার ও তদন্ত কার্যক্রম চলছে।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের ভাষ্য অনুযায়ী, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলাকালে হত্যাকাণ্ডে সংশ্লিষ্টতা, মারণাস্ত্র ব্যবহারে পরামর্শ দেওয়া এবং সহিংসতা উসকে দেওয়ার মতো গুরুতর অভিযোগ আনা হয়েছে। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ও সাধারণ আদালতে বিচারিক প্রক্রিয়া এগোচ্ছে।
কারাগারে থাকা ২৩ বীর মুক্তিযোদ্ধা
২০২৪ সালের আগস্টের পর থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের গ্রেফতার করা হয়। নিশ্চিত তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত অন্তত ২৩ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা কারাবন্দি। তাদের মধ্যে রয়েছেন—সাবেক প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক ই ইলাহি বীর বিক্রম, সাবেক খাদ্যমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু, প্রেসিডিয়াম সদস্য ও মুজিববাহিনীর সাবেক সদস্য শাহজাহান খান, ঢাকা জেলা মুক্তিবাহিনীর সদস্য ড. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, নেত্রকোনা-৫ আসনের সাবেক এমপি আহমেদ হোসেন, সাবেক মন্ত্রী টিপু মুনশি, নীলফামারী-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আফতাব উদ্দিন সরকার, সাবেক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, সাবেক ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু, সিরাজগঞ্জ-৫ আসনের সাবেক এমপি আব্দুল লতিফ বিশ্বাস, সাবেক প্রতিমন্ত্রী মেজর (অব.) ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর বীরউত্তম, ঢাকা-৫ আসনের সাবেক এমপি কাজী মনিরুল ইসলাম মনু, সাবেক মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী বীর প্রতীক, সাবেক চিফ হুইপ আব্দুস শহীদ, সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল মুক্তাদির চৌধুরী, সাবেক প্রতিমন্ত্রী এ বি তাজুল ইসলাম, সাবেক প্রতিমন্ত্রী দীপঙ্কর তালুকদার, সাবেক প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার, সাবেক মন্ত্রী হাসানুল হক ইনু এবং সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন।
এ ছাড়া মেহেরপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের ডেপুটি কমান্ডার ও আমঝুপি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মতিয়ার রহমান এবং যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মুক্তিযোদ্ধা শহিদুল ইসলাম মিলনও কারাগারে রয়েছেন। দেশের বিভিন্ন এলাকায় আরও মুক্তিযোদ্ধা আটক থাকলেও সবার নাম-পরিচয় নিশ্চিত করা যায়নি।
ট্রাইব্যুনালে হাজিরা ও প্রসিকিউশনের বক্তব্য
গত ৮ ডিসেম্বর জুলাই–আগস্ট আন্দোলনকেন্দ্রিক হত্যা ও গণহত্যার অভিযোগে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেখ হাসিনা সরকারের সাবেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীসহ ১৭ জনকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। তাদের মধ্যে আটজন মুক্তিযোদ্ধা। প্রসিকিউশনের দাবি, আসামি বা অপরাধের ধরন বিবেচনায় কাউকে আলাদা করে দেখা হয়নি।
প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম বলেন, “তাদের বেশিরভাগের বিরুদ্ধেই জুলাই গণহত্যার মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংগঠনের অভিযোগ রয়েছে।”
তিনি আরও জানান, জুলাইয়ের মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে অভিযুক্তদের সরাসরি সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। তার ভাষায়, মেনন ও ইনু ১৪ দলের শীর্ষ নেতা হিসেবে শেখ হাসিনাকে কারফিউ জারি, আন্দোলনকারীদের ওপর লেথাল উইপেন ব্যবহার এবং গ্রেফতারের পরামর্শ দেন, যা পরে কার্যকর করা হয়।
নির্দিষ্ট মামলার অগ্রগতি
আসাদুজ্জামান নূরের বিরুদ্ধে ঢাকায় পৃথক দুটি হত্যা মামলা রয়েছে বলে জানান রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মো. জহিরুল ইসলাম। তবে নূরের আইনজীবী অ্যাডভোকেট কাওসার আহমেদের দাবি, এসব মামলায় এখনও দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই।
রাশেদ খান মেননকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে সংঘর্ষে নিহতের ঘটনায় দায়ের করা একাধিক মামলায় আসামি করা হয়। ২২ আগস্ট ডিএমপির এক বার্তায় তাকে গুলশান থেকে গ্রেফতারের তথ্য জানানো হয়।
জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুর বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়েছে। প্রথম সাক্ষী রাইসুল হক জবানবন্দিতে বলেন, “গত বছরের ৫ আগস্টের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি দেখেছেন, শেখ হাসিনার সঙ্গে ফোনকলের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের দমনের জন্য বিভিন্ন পরামর্শ দেন ইনু।”
২০২৪ সালের ২৫ আগস্ট রাতে গোলাম দস্তগীর গাজীকে ঢাকার শান্তিনগরের বাসা থেকে গ্রেফতার করা হয়। তাকে রূপগঞ্জে গুলিতে নিহত দশম শ্রেণির ছাত্র রোমান মিয়া হত্যা মামলাসহ একাধিক মামলায় রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে।
অন্যদের গ্রেফতার ও মামলার অবস্থা
বাকি অভিযুক্তদের বিরুদ্ধেও এক বা একাধিক হত্যা মামলা রয়েছে। ২০২৫ সালের ২০ জানুয়ারি ড. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনকে মোহাম্মদপুর থেকে গ্রেফতার করা হয়। নেত্রকোনা-৫ আসনের সাবেক এমপি আহমদ হোসেন ২০২৪ সালের আগস্টে ডিবির হাতে আটক হন। একই মাসে গুলশান থেকে গ্রেফতার হন টিপু মুনশি। শামসুল হক টুকুকে নিকুঞ্জ এলাকা থেকে, আব্দুল লতিফ বিশ্বাসকে ২০২৫ সালের ৫ জানুয়ারি বেলকুচি থেকে এবং আব্দুস শহীদকে ২০২৪ সালের অক্টোবরে উত্তরা থেকে গ্রেফতার করা হয়।
‘মিথ্যা মামলা’ বিতর্ক
২০২৪ সালের আগস্টের পর শত শত নাম যুক্ত করে দায়ের করা হত্যা মামলার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো। এ প্রসঙ্গে ১০ ডিসেম্বর এক সেমিনারে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, “চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থানের পর কিছু মিথ্যা মামলা হয়েছে, সেগুলো ঠেকাতে সরকার উদ্যোগ নিয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “জুলাই অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক কারণে পুলিশ নিজ উদ্যোগে কোনও রাজনৈতিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে একটি মামলাও করেনি, তবে বেশ কিছু মিথ্যা মামলা হয়েছে।”
এ ধরনের মামলা ঠেকাতে ফৌজদারি কার্যবিধিতে ১৭৩(ক) ধারা সংযোজনের কথাও জানান তিনি, যাতে নিরীহ কেউ হয়রানির শিকার না হন।
সব মিলিয়ে, জুলাই-আগস্ট আন্দোলন ঘিরে দায়ের হওয়া এসব মামলায় দেশের রাজনীতি ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বিচার প্রক্রিয়া এখনো চলমান, যা আগামী দিনে আরও গুরুত্বপূর্ণ মোড় নিতে পারে।