রাতে দেরিতে ঘুমালে হতে পারে যে ৭ ক্ষতি


রাতে দেরিতে ঘুমালে হতে পারে যে ৭ ক্ষতি
প্রতীকী ছবি।

বর্তমান দ্রুতগামী জীবনে অনেকের জন্য রাতে দেরিতে ঘুমানো যেন স্বাভাবিক অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। অফিসের কাজের চাপ কিংবা ব্যক্তিগত বিভিন্ন কারণে অনেকে রাতে ঘুমাতে যেতে দেরি করে থাকেন। আবার কেউ স্মার্টফোন হাতে নিয়ে ফেসবুক, টিকটক স্ক্রল করেন, কেউ গেমসে আসক্ত থাকেন, আবার প্রিয় মানুষের সঙ্গে দীর্ঘসময় ফোনালাপও করেন। এসব কারণে রাতজাগা অনেকের জন্য সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন, রাতজাগা শুধু ক্লান্তির কারণ নয়, এটি শরীর ও মনের উপর দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এবং অন্যান্য চিকিৎসা গবেষণায় পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, রাতে দেরিতে ঘুমালে সাত ধরনের বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারে। রাতে দেরিতে ঘুমানোর ফলে শরীর ও মনের ওপর পড়তে পারে এই সাতটি গুরুতর প্রভাব:

১. হৃদরোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি

ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতালের কার্ডিওলজিস্ট ডঃ রিচার্ড সি. বলেন, “রাতে দেরিতে ঘুমানো রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে বিঘ্ন ঘটায়। ঘুমের অভাবে শরীরের স্ট্রেস হরমোন কোর্টিসল বেড়ে যায়, যা উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদপিণ্ডের সমস্যা বাড়ায়।” নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিনে প্রকাশিত এক দীর্ঘমেয়াদী গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত রাত ১২টার পর ঘুমাতে যান, তাদের হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা ২ থেকে ৩ গুণ বেশি। এছাড়া স্ট্রোক এবং হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকিও উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ে।

২. ওজন বাড়ার সম্ভাবনা

হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের গবেষণায় বলা হয়েছে, দেরিতে ঘুমানোর ফলে লেপটিন নামক হরমোনের উৎপাদন কমে যায়, যা আমাদের ক্ষুধা কমানোর কাজ করে। অপরদিকে ঘ্রেলিন হরমোন বাড়ে, যা ক্ষুধা বাড়িয়ে দেয়। ডঃ পিটার হোয়াইট জানান, “এই পরিবর্তনের কারণে দেরিতে ঘুমানো লোকেরা প্রায়শই বেশি খেতে শুরু করে, বিশেষ করে রাতের খাবারে অতিরিক্ত কার্বোহাইড্রেট ও মিষ্টি গ্রহণ করে, যা ওজন বৃদ্ধির দিকে নিয়ে যায়।” এছাড়া, দেরিতে ঘুমানোর ফলে মেটাবলিজম ধীর হয়ে যায়, যা চর্বি জমার ঝুঁকি বাড়ায়।

৩. মনোবৈকল্য ও বিষণ্নতা

মাইন্ড ইন্সটিটিউটের স্নায়ুবিজ্ঞানী ডঃ সারা মিলার বলেন, “ঘুম কম হলে মস্তিষ্কের ইমোশন নিয়ন্ত্রণকারী অংশ, বিশেষ করে অ্যামিগডালা ও প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সের কার্যকারিতা বিঘ্নিত হয়।” ফলে, মানুষের মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, উদ্বেগ বাড়ে এবং ডিপ্রেশন দেখা দেয়। বিশেষ করে রাতে দেরিতে ঘুমানো দীর্ঘ সময় ধরে চললে বিষণ্নতার প্রকোপ বেড়ে যায়। বিভিন্ন মানসিক স্বাস্থ্য গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত রাতে দেরিতে ঘুমান, তাদের মধ্যে বিষণ্নতার হার তুলনামূলক বেশি।

৪. মেমোরি এবং ফোকাসে সমস্যা

কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা জানিয়েছেন, “ঘুমের সময় মস্তিষ্ক দিনের অভিজ্ঞতাগুলোকে প্রক্রিয়া ও সংরক্ষণ করে। পর্যাপ্ত ঘুম না হলে এই প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়।” প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা রাতে দেরিতে ঘুমান, তাদের স্মৃতিশক্তি ও মনোযোগ কমে যায়। ডঃ লেনা থমাস বলেন, “ঘুমের অভাবে তথ্য গ্রহণ এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে, যা কর্মক্ষমতা ও শেখার দক্ষতাকে প্রভাবিত করে।”

৫. ত্বকের অবনতি

ডার্মাটোলজিস্ট ডঃ নূর আলম বলেছেন, “রাতে ঘুম শরীরের জন্য একটি প্রাকৃতিক রিজুভেনেশন (পুনরুজ্জীবন) প্রক্রিয়া। ঘুম কম হলে ত্বকের কোষগুলো ঠিকমতো পুনর্জন্ম হয় না।” ব্রিটিশ জার্নাল অফ ডার্মাটোলজিতে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ঘুমের অভাবে ত্বকের আর্দ্রতা কমে যায়, ফলে ত্বক শুষ্ক ও টুকরো টুকরো হয়ে যায়। এছাড়াও, দেরিতে ঘুমানো ব্রণ ও ফাইন লাইন বাড়ানোর সাথে জড়িত। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভালো ঘুম ত্বকের প্রাকৃতিক উজ্জ্বলতা বজায় রাখতে সাহায্য করে।

৬. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস

আমেরিকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথ (NIH) জানিয়েছে, পর্যাপ্ত ঘুম শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বজায় রাখতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ডঃ লরেন স্মিথ বলেছেন, “ঘুম কম হলে শরীরের সাদা রক্তকণিকার কার্যক্ষমতা কমে যায়, যার ফলে ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া থেকে সুরক্ষা কমে যায়।” গবেষণায় দেখা গেছে, যারা রাতে দেরিতে ঘুমায় তাদের সাধারণ সর্দি-কাশি, ফ্লু এবং অন্যান্য সংক্রমণে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি।

৭. জীবনকাল হ্রাস

জাপানের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথ অ্যান্ড ন্যাচারাল সায়েন্সেসের এক দীর্ঘমেয়াদী গবেষণায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, যারা নিয়মিত রাতে দেরিতে ঘুমায় তাদের গড় আয়ু কম। গবেষণায় বলা হয়েছে, ঘুমের অভাব ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, এবং অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদী অসুস্থতার কারণ হতে পারে, যা জীবনকাল হ্রাস করে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন, স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপনের জন্য সঠিক সময়ে ঘুমানো অপরিহার্য।

সুস্থ থাকার জন্য ঘুমের পরামর্শ

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুস্থ থাকতে হলে ঘুমের উপর নজর দেয়া অত্যন্ত জরুরি। প্রতিদিন একই সময়ে ঘুমাতে যাওয়া এবং উঠার অভ্যাস গড়ে তোলা উচিত। এটি শরীরের অভ্যন্তরীণ ঘড়ির কার্যকারিতা ঠিক রাখে। ঘুমের আগে মোবাইল, কম্পিউটার বা টিভির স্ক্রিন থেকে দূরে থাকা ভালো, কারণ এগুলোর ব্লু লাইট মেলাটোনিন হরমোনের সৃষ্টিতে ব্যাঘাত ঘটায়, যা ঘুমের গুণমান কমিয়ে দেয়। রাতে ভারি বা তৈলাক্ত খাবার এড়িয়ে চলা জরুরি, কারণ এগুলো হজমে বাধা দেয় এবং ঘুমের স্বাভাবিক চক্রকে বিঘ্নিত করে। ক্যাফেইন জাতীয় পানীয়ও ঘুমের জন্য ক্ষতিকর, তাই সন্ধ্যার পরে কফি, চা বা সোডা গ্রহণ থেকে বিরত থাকা উচিত।

সুস্থ ঘুমের জন্য শিথিলতা আনা খুবই জরুরি। ঘুমানোর আগে ধ্যান, হালকা যোগব্যায়াম অথবা গভীর শ্বাস-প্রশ্বাসের অনুশীলন মনকে শান্ত করে ঘুমের জন্য প্রস্তুত করে। এছাড়াও, শোবার ঘরটা অন্ধকার, নীরব এবং ঠান্ডা রাখা উচিত, কারণ এসব পরিবেশ ঘুমকে উন্নত করে। নিয়মিত ব্যায়ামও ঘুমের জন্য সহায়ক, তবে রাতের দিকে ভারী ব্যায়াম এড়ানো উচিত। অবসরের জন্য গরম গোসল বা বই পড়ার মতো কাজও ঘুমের গুণমান বাড়াতে সাহায্য করে।

যদি ঘুমের সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী হয়, তবে অবশ্যই একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। কারণ অনেক সময় ঘুমের সমস্যা অন্যান্য স্বাস্থ্যগত জটিলতার লক্ষণ হতে পারে।

ঢাকাওয়াচ২৪ডটকমে লিখতে পারেন আপনিও ফিচার, তথ্যপ্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, ভ্রমণ ও কৃষি বিষয়ে। আপনার তোলা ছবিও পাঠাতে পারেন [email protected] ঠিকানায়।
×