শরীয়তপুরে তুচ্ছ ঘটনায় ব্যবহার হয় বোমা, ২৫ বছরে ৮০ সংঘর্ষে নিহত আট


April 2025/Boma.png

শরীয়তপুর জেলার সদর উপজেলার বিলাসপুর ইউনিয়নে আধিপত্য বিস্তার ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের মধ্যে দীর্ঘ দিন ধরে চলা সংঘর্ষের চিত্র যেন রণক্ষেত্রের মতো। চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য কুদ্দুস বেপারী এবং স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা জলিল মাতবরের অনুসারীদের সংঘর্ষে এখন পর্যন্ত আহত হয়েছেন হাজারেরও বেশি মানুষ, নিহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন। আর দুই পক্ষের বিরুদ্ধে দেশে রয়েছে ৯৭টি মামলা।

২০০১ সাল থেকে শুরু হওয়া এই বিরোধে দুই পক্ষের মধ্যে অন্তত ৮০ বার সংঘর্ষ হয়েছে। কোনো জমি-জমা নিয়ে নয়, শুধুমাত্র রাজনৈতিক আধিপত্য ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন ঘিরেই এসব সংঘর্ষ ঘটেছে। এসব সংঘর্ষে সাধারণ দেশীয় অস্ত্রের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়েছে হাতবোমা ও ককটেল। এতে এলাকাবাসী যেমন আতঙ্কিত, তেমনি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
 
সংঘর্ষে যারা প্রাণ হারিয়েছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন ২০০৩ সালে প্রবাসী বারি মাতবর, ২০০৭ সালে ফারুক ও জব্বার মাতবর, ২০১৩ সালে আবুল সরদার, ২০১৪ সালে রাজ্জাক মাতবর, ২০১৫ সালে একাধিক শিক্ষার্থী এবং ২০২৪ সালে তারাবির নামাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে নিহত সজীব মুন্সি।
 
২০২৪ সালের আরেকটি হৃদয়বিদারক ঘটনার শিকার হন ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী সৈকত সরদার। সংঘর্ষের ভিডিও মোবাইলে ধারণ করছিল সে। হঠাৎ বোমার আঘাতে গুরুতর আহত হয়। আহত অবস্থাতেই বোমা জলিলের অনুসারীরা সৈকতকে বেধড়ক মারধর করে হত্যা করে বলে অভিযোগ উঠে।
 
সৈকতের মা শাহনাজ বেগম বলেন, ‘এলাকায় যখন মারামারি হচ্ছিল, তখন আমার ছেলে ভিডিও করছিল। এমন সময় তার গায়ে বোমা লাগে। পড়ে যাওয়ার পরেও ওরা আমার ছেলেকে লাঠি-সোঁটা দিয়ে পেটায়, আছাড় মারে। তারপর ওর মাথা মাটিতে বাড়ি মেরে মৃত্যু নিশ্চিত করে চলে যায়। যেতে যেতে বলে- “শালারে শেষ কইরা দিছি”।’
 
তিনি আরও বলেন, ‘আমি মামলা করলে আসামিপক্ষ আমাকে ৫০ লাখ টাকা দিয়ে মামলা তুলে নিতে বলে। আমি বলি, আমাকে যত টাকা দাও আমি মামলা ছাড়বো না। সন্তান হত্যার বিচার চাই।’ মামলার পরেও কয়েক দিনের মধ্যে আবারও সংঘর্ষ শুরু হয় এবং অভিযুক্তদের অনুসারীরা তার বাড়িতে হামলা চালিয়ে বাড়িঘর ভাঙচুর করে, লুটপাট চালায়।’
 
নিহত সজীব মুন্সির মা নুরুন্নাহার বেগম বলেন, ‘আমার ছেলে অত্যন্ত ভদ্র ছিল। সে ঢাকায় থাকতো, বাড়ি এলে এলাকার সবার সাথে মিশতো। ইফতারের পর এশা ও তারাবির নামাজ পড়ে ফেরার পথে কুদ্দুসের লোকজন ওর ওপর বোমা মারে। পেটে বোমা পড়ে ওর ভুঁড়ি বেরিয়ে যায়। ঢাকায় নেয়ার পর অপারেশনে দেখা যায় ওর শরীরে তারকাটা, কাচের টুকরো, পাথরের স্প্লিন্টার পাওয়া যায়।’
 
তিনি অভিযোগ করেন, ‘আমরা মামলা করলেও পুলিশ নেতাদের কথায় আসামিদের গ্রেফতার করে না। পরে সবাই জামিনে বেরিয়ে আসে। এই দেশে বিচার নেই।’
 
বিলাসপুর ইউনিয়নের এই সংঘর্ষে বহু মানুষ হাত, পা, চোখসহ বিভিন্ন অঙ্গ হারিয়েছেন। পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে অন্তত ২০টি বাড়ি। আতঙ্কে অনেকে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গেছেন ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায়। স্কুল-মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কমেছে। বাজারগুলোও এখন জনশূন্য।
 
স্থানীয়রা বলছেন, সংঘর্ষ শুরু হলে তা থেমে থেমে মাসব্যাপী চলে। সাবেক কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ছত্রছায়া থাকায় এত বড় বড় ঘটনার পরও প্রশাসন দীর্ঘদিন কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারেনি।
 
তবে এবারের পরিস্থিতি কিছুটা ব্যতিক্রম। ৫ এপ্রিল সকালে ইউনিয়নের আহসানুল্লাহ মুন্সীকান্দি, দূর্বাডাঙ্গা ও বিলাসপুর এলাকায় ফের সংঘর্ষে জড়ায় দুই পক্ষের লোকজন। এতে আহত হন অন্তত ১৬ জন। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ৯ জনকে আটক করে এবং পরদিন ৮৮ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও ১ হাজার জনকে আসামি করে মামলা করে।
 
জাজিরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ দুলাল আকন্দ বলেন, ‘এই এলাকার সংঘর্ষ ভিন্নমাত্রার। এখানে মারামারির মানেই ককটেল বিস্ফোরণ। আমরা তথ্য সংগ্রহ করছি, কোথা থেকে বোমার সরঞ্জাম আসছে খতিয়ে দেখছি। আগের মতো প্রশাসনকে আর বাধা দেয়া যাবে না। এবার আমরা কঠোর হাতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনবো।’
 
তিনি বলেন, ‘সংঘর্ষে জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, অনেককে গ্রেফতারও করা হয়েছে। আশা করছি বাকি আসামিদেরও দ্রুত আটক করে এলাকায় শান্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।’
 
চাঞ্চল্যকর এই ‘বোমা যুদ্ধ’-এর দুই মূল হোতা- কুদ্দুস বেপারীর নামে দেশের বিভিন্ন থানায় ৪৭টি এবং জলিল মাতবরের নামে ৫০টি মামলা রয়েছে। বর্তমানে তারা শরীয়তপুর জেলা কারাগারে আটক আছেন।

ঢাকাওয়াচ২৪ এর খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন ।
ঢাকাওয়াচ২৪ডটকমে লিখতে পারেন আপনিও ফিচার, তথ্যপ্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, ভ্রমণ ও কৃষি বিষয়ে। আপনার তোলা ছবিও পাঠাতে পারেন [email protected] ঠিকানায়।
×