
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশে অবস্থিত জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মাজারে ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক ওসমান হাদিকে দাফন করার সিদ্ধান্তে প্রতিবাদ জানিয়েছেন কবির পরিবারের সদস্যরা।
ওসমান হাদির মৃত্যুর পর শুক্রবার গভীর রাতে জরুরি বৈঠকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেয়, নজরুলের সমাধি চত্বরে হাদিকে দাফন করা হবে। শনিবার দুপুরে মরদেহ আনা হয় ক্যাম্পাসে এবং বিকেল চারটার দিকে দাফন সম্পন্ন হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়াজ আহমেদ খান এ সিদ্ধান্তের পক্ষে যুক্তি দিয়ে বলেন, ওসমান হাদি “ইতিহাসের অংশ” এবং দেশের জন্য তাঁর ত্যাগ রয়েছে।
ভারতীয় পত্রিকা আনন্দবাজারের এক প্রতিবেদনের বরাতে জানা যায়, এই সিদ্ধান্তকে স্বাভাবিক প্রশাসনিক প্রক্রিয়া হিসেবে দেখছেন না ভারতের পশ্চিম বর্ধমানের চুরুলিয়ায় কবির জন্মভূমিতে বসবাসকারী তাঁর পরিবারের সদস্যরা।
প্রতিবেদনে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী নজরুলের পরিবারের সদস্য সোনালি কাজী এবং স্বরূপ কাজীর বক্তব্য, যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তা অনৈতিক। নিয়ম মতো ওই স্থানে বিশেষ কয়েক জনকে সমাধিস্থ করা হয়। এত জায়গা থাকতে নজরুলের সমাধির পাশে হাদিকে সমাধিস্থ করার সিদ্ধান্তের নেপথ্যে রাজনীতি রয়েছে। সোনালি বলেন, ‘‘আমাদের প্রাণের কবি বাংলাদেশে শেষ জীবন কাটিয়েছেন। এত দিন বাংলাদেশে আমরাও (পরিবারের অন্যেরা) ভাল ছিলাম। কিন্তু এখন যা হচ্ছে...।’’
তাঁর সংযোজন, ‘‘ওই কবরস্থানে সকলকে সমাধিস্থ করা হয় না। কিন্তু ছায়ানট ভাঙচুর করা, রবীন্দনাথের বই পুড়িয়ে দেওয়া বাংলাদেশিদের উগ্রবাদীরা হাদিকে সমাধিস্থ করলেন কবির সমাধির পাশে! এটা হল কেন? নজরুল যেখানে সম্প্রীতির বার্তা দিয়ে গিয়েছেন, জাতের নামে বজ্জাতির কথা বলেছেন, তখন তাঁর সমাধির পাশে এমন এক জনকে সমাধিস্থ করা হল সরকারেরই নির্দেশে!’’ তাঁর আশঙ্কা, আগামিদিনে হয়তো কবির সমাধিও ওখানে থাকবে না। তিনি বলেন, ‘‘পৃথিবীতে ভাল মানুষের জায়গা কি হারিয়ে যাচ্ছে? রবীন্দ্রনাথ-নজরুলকে কি পরবর্তী প্রজন্ম অস্বীকার করবে? আমাদের আর্জি, নজরুলকে যেন অসম্মান করা না-হয়। তবে এই সরকারের (বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার) দায়বদ্ধতা নেই। আমরা ভীষণ মনোকষ্টে রয়েছি। আমরা মর্মাহত।’’
কবির পরিবারের আর এক সদস্য স্বরূপ জানান, ১৯৭৬ সালে বিদ্রোহী কবি নজরুলকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশে সমাহিত করা হয়। সেখানে আততায়ীদের গুলিতে নিহত কট্টরপন্থী নেতাকে কোন যুক্তিকে কবর দেওয়া হয়, তাঁর মাথায় ঢুকছে না।
উল্লেখ্য, ১৯৭৬ সালে নজরুলের মৃত্যুর পর রাষ্ট্রপক্ষ সিদ্ধান্ত নেয় নজরুলকে এমন স্থানে দাফন করা হবে, যা কেবল তার নামেই পরিচিত থাকবে। এই সিদ্ধান্তই মাজারকে স্বতন্ত্র জাতীয় প্রতীকে পরিণত করে। ঐ স্থানে আগে থেকেই যুক্ত ছিল শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের কবর।
সত্তরের শেষভাগ ও আশির দশকে মাজারটি মূলত একটি সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের পরিসর হিসেবেই পরিচিত ছিল। সেসময়ে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল হক বাবলু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্রাবাসে বোমা বিস্ফোরণে নিহত হলে ছাত্রদল বাবলুকে কাজী নজরুল ইসলামের মাজারে দাফনের দাবি তোলে। সরকার সেই দাবি স্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করে। দীর্ঘ টানাপোড়েনের পর রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তই কার্যকর হয় এবং বাবলুকে অন্যত্র দাফন করা হয়।
পরবর্তীতে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের উত্তাল মুহূর্তে, ১৯৮৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারি, জাতীয় কবিতা পরিষদের মঞ্চে হঠাৎ মৃত্যুবরণ করেন শিল্পী কামরুল হাসান। কামরুল হাসানের সাংস্কৃতিক মর্যাদার কারণে তাকে নজরুলের মাজারে জয়নুল আবেদিনের পাশেই দাফন করা হয়। এর প্রায় ৩৭ বছর পর ২০২৫ সালের ২০ ডিসেম্বর একই মাজারে দাফন করা হয় ভারতীয় আধিপত্যবাদ বিরোধী সাংস্কৃতিক বিপ্লবী ওসমান হাদিকে।
গত ১২ ডিসেম্বর ঢাকায় গুলিবিদ্ধ হন হাদি। প্রথমে তাঁকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের জরুরি বিভাগে ভর্তি করানো হয়েছিল। কিন্তু পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক দেখে উন্নত চিকিৎসার জন্য সরকারি উদ্যোগে হাদিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সিঙ্গাপুরে। গত বৃহস্পতিবার রাতে সেখানেই মৃত্যু হয় তাঁর।