
জাতীয় রাজনীতির সাম্প্রতিক আলোচনায় নতুন মাত্রা যোগ করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। তাঁর মতে, শেখ হাসিনা রাজনীতিতে জননেত্রী হিসেবেই প্রবেশ করেছিলেন, কিন্তু দেশের সামগ্রিক ব্যবস্থা শেষ পর্যন্ত তাকে স্বৈরাচারী শাসনের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
সোমবার ৮ ডিসেম্বর আগারগাঁওয়ের পর্যটন ভবনে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক সম্মেলনের সমাপনী অধিবেশনে তিনি এ মন্তব্য করেন। ‘গণতন্ত্র ও উন্নয়ন’ শীর্ষক আলোচনার সঞ্চালনায় ছিলেন বিআইডিএস মহাপরিচালক ড. এনামুল হক।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, "শেখ হাসিনা একজন জননেত্রী হিসেবে রাজনীতিতে এসেছিলেন, স্বৈরাচার হয়ে জন্মাননি। কিন্তু সমাজ যখন নৈতিকতা হারায়, প্রশাসন যখন নিজের অবস্থান থেকে সরে যায়, বুদ্ধিজীবীরা যখন দলীয় স্বার্থে নীরব থেকে যান এবং ভোটার যখন প্রার্থীর যোগ্যতা উপেক্ষা করে শুধু মার্কা দেখে ভোট দেন; তখন আমরাই তাকে এমন অবস্থানে বসাই; যেখানে ক্ষমতা অনিয়ন্ত্রিত হয়ে ওঠে। তাই তাকে স্বৈরাচার করেছে সিস্টেম এবং সেই সিস্টেমের নির্মাতা আমরাই।"
ব্যবসায়ীদের আচরণ উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরে তিনি বলেন, "আমাদের ব্যবসায়ী কমিউনিটি শেষ দিকের একটি মিটিংয়ে বলেছেন 'আমি তোমাকেই চাই, বারে বারে শুধু তোমাকেই চাই'। অর্থাৎ, আমাদের ব্যবসায়ী কমিউনিটি বলেছে তাকে ছাড়া দেশ চলবে না; এই যে একটা অবস্থায় আমরা যেই দিকে নিয়ে যাই। এটার পেছনে আমাদের আত্মবিশ্লেষণ প্রয়োজন।"
গভর্নর দুঃখ প্রকাশ করে বলেন যে গত ১৫ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষক সমাজ কিংবা বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে কোনো দৃশ্যমান প্রতিবাদ দেখা যায়নি। তিনি মন্তব্য করেন, "যে জায়গাটাকে আমরা সুশীল সমাজ বলি, সেখানকার অবস্থাও অ্যানকম্প্রোমাইজড হওয়া উচিত ছিল। হ্যাঁ আমি কোনো দলকে সমর্থন করতেই পারি, কিন্তু 'নট বিয়ন্ড নর্ম'।"
তিনি আরও বলেন, দেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকট এবং গণতান্ত্রিক ব্যর্থতার দায় কেবল নেতৃত্ব বা সরকারের ওপর চাপিয়ে দিলে হবে না। তাঁর ভাষায়, "ভোটার, বুদ্ধিজীবী, ব্যবসায়ী, প্রশাসন; সবাই মিলে নৈতিক অবস্থান হারিয়েছে। ভোট দেওয়ার দিনটিকেই আমরা গণতন্ত্র ভেবে নিয়েছি, অথচ গণতন্ত্র হল প্রতিদিনের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, ক্ষমতাকে প্রশ্ন করা, নৈতিকতা বজায় রাখা এবং নেতৃত্বকে নিয়মিত মূল্যায়ন করা।"
যোগ্য প্রার্থী থাকা সত্ত্বেও ভোটারদের দলকেন্দ্রিক পছন্দে তারা পরাজিত হন বলেও মন্তব্য করেন তিনি। "যোগ্য প্রার্থী থাকলেও জনগণ মার্কার প্রতি অন্ধ সমর্থনের কারণে তাকে ভোট দেন না। ফলে যারা রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক ভারসাম্য আনতে পারতেন, তারা হারিয়ে যান। এই সংস্কৃতির ফলেই ক্ষমতা ধীরে ধীরে একচেটিয়া হয়ে পড়ে এবং নেতার চারপাশের সুবিধাভোগী গোষ্ঠী তাকে এমন কাঠামোর কেন্দ্রে ঠেলে দেয়; যেখানে জবাবদিহিতা বিলীন হয়ে যায়," বলেন গভর্নর।
তিনি আরও বলেন, "জনগণ এখনও প্রার্থীর যোগ্যতা নয়; বরং দল ও মার্কা দেখে ভোট দেন। ফলে যোগ্য নেতৃত্ব পথেই আসতে পারে না এবং এর ধারাবাহিকতায় রাষ্ট্রযন্ত্রের ভেতরেই স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতা জন্ম নেয়।"
গণতন্ত্র ও উন্নয়ন সম্পর্কে তাঁর পর্যবেক্ষণ, "গণতন্ত্র ও উন্নয়ন হাত ধরাধরি করে চলে; একটিকে দুর্বল রেখে অন্যটিকে এগিয়ে নেওয়া অসম্ভব।"
সমাপনী বক্তব্যে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান বলেন, "শক্তিশালী গণতন্ত্র ছাড়া টেকসই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি সম্ভব নয়; সুতরাং গণতন্ত্রকে দুর্বল রেখে আর্থিক উন্নয়নের আশা করা বিভ্রান্তিকর।"