
বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সর্বশেষ ঘোষণা। তিনি জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র আবারও পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা চালানোর পরিকল্পনা করছে। এতে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ লিখেছেন, “যেহেতু অন্যান্য দেশও তাদের নিজস্ব পারমাণবিক কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে, তাই আমি যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ বিভাগকে সমতার ভিত্তিতে পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা শুরু করার নির্দেশ দিয়েছি।” তিনি আরও জানিয়েছেন, এই পরীক্ষাগুলো দ্রুত শুরু হবে।
বিশ্বের পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলো নিয়মিত ক্ষেপণাস্ত্রসহ বিভিন্ন পারমাণবিক উপাদান বহনে সক্ষম অস্ত্রের পরীক্ষা চালালেও, ১৯৯০-এর দশকের পর থেকে কেবল উত্তর কোরিয়াই পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পরীক্ষা করেছে। তাদের সর্বশেষ পরীক্ষা হয়েছিল ২০১৭ সালে।
ট্রাম্পের এই ঘোষণার পর হোয়াইট হাউস এখনও কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া দেয়নি। ফলে স্পষ্ট নয়, তিনি শুধু পারমাণবিক অস্ত্রের সরবরাহব্যবস্থা পরীক্ষা করতে চান, নাকি সরাসরি বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পরীক্ষা চালাতে চান। নিজের বার্তার মন্তব্যে ট্রাম্প আরও বলেন, পরীক্ষার স্থান পরে জানানো হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যখন বিশ্বজুড়ে পারমাণবিক প্রতিযোগিতা ক্রমেই তীব্র হচ্ছে, তখন এই ঘোষণা সেই প্রতিযোগিতাকে আরও উসকে দিতে পারে। কার্নেগি এনডাওমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের ফেলো জেমি ওয়াং বলেন, “উত্তর কোরিয়া ছাড়া অন্য কোনো পারমাণবিক শক্তিধর দেশ কয়েক দশক ধরে পরীক্ষা চালায়নি। তাই আশঙ্কা আছে, এই ঘোষণা অন্যদেরও প্রভাবিত করতে পারে।” তার মতে, এটি একটি উদ্বেগজনক সময়, কারণ যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা ভবিষ্যতে অস্ত্র প্রতিযোগিতার দিকে নিয়ে যেতে পারে।
লন্ডনভিত্তিক প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তাবিষয়ক থিংক ট্যাংক ‘রুসি’র সিনিয়র ফেলো দারিয়া দোলঝিকোভা মনে করেন, ট্রাম্পের ঘোষণায় তেমন বড় কোনো পরিবর্তন আসবে না। তিনি বলেন, বৈশ্বিক পর্যায়ে ইতিমধ্যেই এমন অনেক কারণ আছে, যা পারমাণবিক সংঘাতের ঝুঁকি এবং অস্ত্র বিস্তারকে আগের চেয়ে অনেক বেশি বাড়িয়ে তুলেছে।
বিশ্লেষকরা ইউক্রেন যুদ্ধ, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের পারমাণবিক হুমকি, দক্ষিণ এশিয়ায় পাকিস্তান-ভারত উত্তেজনা এবং ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের দিকেও ইঙ্গিত করেছেন। তাদের মতে, এসব ঘটনাই বৈশ্বিক অস্থিরতা বাড়াচ্ছে। ইসরায়েল কখনও আনুষ্ঠানিকভাবে পারমাণবিক অস্ত্রের মালিকানা স্বীকার বা অস্বীকার করেনি, আর ইরান এই অস্ত্র তৈরির অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। পাশাপাশি তাইওয়ান ও কোরীয় উপদ্বীপকে ঘিরে চীনের নীতি বিশ্ব পরিস্থিতিকে আরও জটিল করছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তির মেয়াদ আগামী ফেব্রুয়ারিতে শেষ হবে। ট্রাম্প দাবি করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে যেকোনো দেশের তুলনায় বেশি পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে। কিন্তু স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, রাশিয়ার কাছে সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ পাঁচ হাজার চারশ ঊনষাটটি, যুক্তরাষ্ট্রের আছে পাঁচ হাজার একশ সাতাত্তরটি এবং চীনের আছে ছয়শ অস্ত্র।
সম্প্রতি রাশিয়া নতুন এক পারমাণবিক সরবরাহ ব্যবস্থা পরীক্ষা করেছে। ক্রেমলিন জানিয়েছে, তাদের ক্ষেপণাস্ত্র মার্কিন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ভেদ করতে পারে এবং সমুদ্রপথে যুক্তরাষ্ট্রের উপকূলে পৌঁছানোর ক্ষমতাও রাখে। যদিও রাশিয়া বলেছে, এসব পরীক্ষা “পারমাণবিক ছিল না”, কিছু বিশেষজ্ঞের ধারণা, এই পদক্ষেপই ট্রাম্পকে নতুন ঘোষণা দিতে প্রভাবিত করেছে।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র যদি আবার পারমাণবিক পরীক্ষা শুরু করে, তবে রাশিয়া ও চীনও একই পথ অনুসরণ করতে পারে। চীন জানিয়েছে, তারা আশা করে যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক পরীক্ষা নিষিদ্ধকরণ চুক্তির শর্ত মেনে চলবে এবং পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ বন্ধ রাখবে।
ওয়াশিংটনের আর্মস কন্ট্রোল অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী পরিচালক ড্যারিল ক্যাম্পবেল বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক পরীক্ষা পুনরায় শুরু করা “আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার দৃষ্টিকোণ থেকে একটি ঐতিহাসিক ভুল” হবে। তিনি বলেন, পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকি দ্রুত বাড়ছে এবং যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়ার মধ্যে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আলোচনা না হলে বিশ্ব খুব শিগগিরই যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীনের মধ্যে বিপজ্জনক অস্ত্র প্রতিযোগিতার মুখে পড়বে।
ফেডারেশন অব আমেরিকান সায়েন্টিস্টসের পারমাণবিক তথ্যবিষয়ক পরিচালক হ্যান্স ক্রিস্টেনসেন বলেন, “গত পাঁচ বছরে পারমাণবিক অস্ত্রের হুমকি বেড়েছে, যা সাধারণ মানুষের জন্যও উদ্বেগের বিষয়।”
যুক্তরাষ্ট্র সর্বশেষ পারমাণবিক পরীক্ষা চালিয়েছিল ১৯৯২ সালে, নেভাডা অঙ্গরাজ্যে ভূগর্ভে। বিশ্লেষক ক্যাম্পবেল মনে করেন, সেই স্থাপনাকে পুনরায় প্রস্তুত করতে কমপক্ষে ছত্রিশ মাস সময় লাগবে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা না করে কম্পিউটার সিমুলেশন ও অন্যান্য অ-বিস্ফোরক পদ্ধতি ব্যবহার করছে। ফলে বিস্ফোরণ ঘটানোর বাস্তব যুক্তি এখন তেমন নেই বলে মনে করেন অনেক বিশেষজ্ঞ।
বিশ্লেষক জেমি ওয়াং জানান, ভূগর্ভস্থ পরীক্ষার ক্ষেত্রেও বড় ঝুঁকি রয়েছে, কারণ এতে বিকিরণ ছড়িয়ে পড়া বা ভূগর্ভস্থ পানির দূষণের আশঙ্কা থাকে।
রক্ষণশীল মার্কিন থিংক ট্যাংক ‘দ্য হেরিটেজ ফাউন্ডেশন’-এর গবেষক রবার্ট পিটার্সের মতে, এই পরীক্ষার মূল উদ্দেশ্য বৈজ্ঞানিক নয়, বরং প্রতিপক্ষকে রাজনৈতিক বার্তা দেওয়া। তিনি বলেন, “কখনও কখনও প্রেসিডেন্টের জন্য শক্তি প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা প্রয়োজন হতে পারে।”
তিনি আরও বলেন, পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত থাকা ‘অযৌক্তিক নয়’, যদিও অনেক বিশেষজ্ঞের মতে বর্তমান পরিস্থিতিতে এমন পদক্ষেপ অত্যন্ত বিপজ্জনক হতে পারে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথমবারের মতো পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা চালায় এবং একই বছর আগস্ট মাসে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে বোমা নিক্ষেপ করে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারকারী দেশ হিসেবে পরিচিতি পায়।
ঢাকাওয়াচ২৪ডটকমে লিখতে পারেন আপনিও ফিচার, তথ্যপ্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, ভ্রমণ ও কৃষি বিষয়ে। আপনার তোলা ছবিও পাঠাতে পারেন[email protected]ঠিকানায়।
ঢাকাওয়াচ২৪ডটকমে লিখতে পারেন আপনিও ফিচার, তথ্যপ্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, ভ্রমণ ও কৃষি বিষয়ে। আপনার তোলা ছবিও পাঠাতে পারেন[email protected]ঠিকানায়।