বিলুপ্তির পথে গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য ‘গোলা’
- পাবনা প্রতিনিধি
- প্রকাশঃ ১১:১৮ এম, ০২ এপ্রিল ২০২৫

এক সময় গ্রামাঞ্চলের প্রায় প্রতিটা বাড়িতে দেখা মিলতো বাঁশ, বেত, মাটি আর টিনের ছাউনিতে তৈরি ধানসহ দানাজাতীয় ফসল রাখার বড় আধার ‘গোলা’। দীর্ঘ দিন ধান সংরক্ষণ করে রাখা যায় এসব গোলায়। এখন আর গ্রামে ঘরে ঘরে দেখা যায় না বিশেষ এই ঘর। তবে পাবনার চাটমোহরে কৃষি ঐতিহ্যের স্মৃতিস্মারক হয়ে এখনো কৃষকের বাড়িতে দৃশ্যমান ‘গোলা’।
আগের দিনে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ক্ষেতের ধান গোলায় মজুত করতেন। বসতবাড়ির আঙিনায় মাটি, বাঁশ আর টিনের ছাউনি দিয়ে তৈরি করতেন বিশেষ এই ঘর। বর্ষার পানির প্রবেশ ঠেকাতে গোলা বসাতো হতো উঁচু জায়গায়। গোলায় প্রবেশের জন্য রাখা হতো একটি দরজা। চোরের হাত থেকে ফসল রক্ষায় দরজায় মারা হতো তালা। তবে আধুনিকতার ছোঁয়ায় এখন সেই জায়গাগুলো দখল করে নিয়েছে বিশেষ সুবিধাসম্পন্ন গুদামঘর। তবে চলনবিল অধ্যুষিত বেশ কিছু এলাকার কৃষকরা তাদের বাপ-দাদার স্মৃতি ধরে রাখতে এখনো যত্ন করে রেখেছেন গোলাগুলো।
সরেজমিন দেখা যায়, পাবনার চাটমোহর পৌর সদরের জিরো পয়েন্ট এলাকার সাবেক সাংসদ কেএম আনোয়ারুল ইসলামের বাড়ির উঠানের এক পাশে আজও দাঁড়িয়ে আছে তিনটি ধানের গোলা। গোলা তিনটির বয়স প্রায় ৭০ বছর। স্মৃতি ধরে রাখতে মাঝে মাঝেই এগুলো সংস্কার করেন তিনি।
স্থানীয়রা জানান, এক ময় প্রায় কৃষকের বাড়িতেই ধান মজুত রাখতে বাঁশ, বেত ও কাদা দিয়ে তৈরি করা হতো গোলা। গোলার ভেতরে ও বাইরে বেশ পুরু করে লাগানো হতো মাটির আস্তরণ। গোলার দরজা করা হতো উঁচুতে, যাতে সহজেই চোর ধান চুরি না করতে পারে। গোলা নির্মাণ করতে বিভিন্ন এলাকা থেকে আনা হতো দক্ষ কারিগর।
বাড়িতেই তৈরি করা হতো ধানের গোলা। তবে এ পেশায় আর কাজ না থাকায় এখন ভিন্ন পেশা বেছে নিয়েছেন কারিগররা। অতীতে সমাজের নেতৃত্ব নির্ভর করতো কার কয়টি ধানের গোলা আছে তার ওপর। শুধু তাই নয়, কন্যা ও বরপক্ষের বাড়ির লোকজনও খবর নিতেন কার কয়টা গোলা রয়েছে। যা এখন নতুন প্রজন্মের কাছে রূপকথার গল্প।
উপজেলার বিলচলন ইউনিয়নের সত্তরোর্ধ্ব সবুজ মোল্লা। গোলার স্মৃতি বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি জানান, এক সময় ভাদ্র মাসে জমিতে পানি থাকতো। সেই পানির আউশ ধান ধান কেটে গোলায় রাখা হতো। তবে ভেজা ধান কেটে গোলায় রাখলে দ্রুত শুকিয়ে যেত। এজন্য ধান শুকিয়ে রাখা হতো গোলায়। এছাড়া ইঁদুর ও পোকামাকড়ের উৎপাত থেকে ফসল রক্ষায় গোলা খুবই উপকারী। একটি বড় গোলায় সাধারণত ২০০-৩০০ মণ পর্যন্ত ধান রাখা যেতো। কিন্তু এসব এখন আর নেই।
একই এলাকার বৃদ্ধা আবেদা খাতুন জানান, আগে প্রায় সব বাড়িতেই ধানের গোলা দেখা যেতো। সারাবছর গোলা থেকেই ধান বের করে তা সিদ্ধ ও শুকানোর মাধ্যমে ঢেঁকিতে পাড় দিয়ে তৈরি করা হতো চাল। বর্তমানে মিল-কারখানা আর চাতাল হওয়ায় এখন আর এগুলো করতে হয় না।
এ বিষয়ে কে এম আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের গোলাটির বয়স প্রায় ৭০ বছর। আমি ছোটবেলা থেকে দেখছি বাবা-মা এই গোলায় ধান রাখতেন। সারা বছর তিনটি গোলায় প্রায় ৬০০ মণ ধান রাখা যায়। সেই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে এখনো প্রতিবছর গোলাগুলো মেরামত করে ধান রাখি।’
তিনি বলেন, ‘আগে উৎপাদিত ফসলের বড় একটি অংশ গোলায় মজুত করে রাখা হতো। পরে প্রয়োজন বিবেচনায় বছরজুড়ে ফসল বিক্রি করতেন তারা। এখন সেগুলো নেই। ফলে কৃষকরা এখন ফসল উঠতেই সব বিক্রি করে দেন।’
আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘কালের সাক্ষী হিসেবে এখনো গোলাগুলো যত্ন করে রেখেছি। মাঝে মধ্যেই বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী গোলা দেখতে আসেন, ছবি তোলেন।’