
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে (জবি) ২০২৫–২৬ শিক্ষাবর্ষের স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত এক ঘটনার সূত্র ধরে আবারও প্রশ্ন উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক সংস্কৃতি, রাজনৈতিক প্রভাব ও ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে। ভর্তি পরীক্ষার মতো সংবেদনশীল সময়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত এক অধ্যাপকের আচরণ শুধু সাংবাদিক সমাজকেই নয়, পুরো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকেই বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে।
তথ্য জানতে গিয়ে সাংবাদিকদের ‘স্টুপিড’ বলে গালিগালাজ ও হেনস্তার অভিযোগ উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আবদুল আলীমের বিরুদ্ধে। অভিযোগ উঠেছে, দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়েই তিনি এমন দম্ভপূর্ণ আচরণ করে আসছেন।
শুক্রবার (২৬ ডিসেম্বর) সকাল সাড়ে ১১টার দিকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারের সামনে এ ঘটনা ঘটে। ওই দিন ‘এ’ ইউনিটের (বিজ্ঞান ও লাইফ অ্যান্ড আর্থ সায়েন্স অনুষদ) ভর্তি পরীক্ষায় ভুলক্রমে অন্য কেন্দ্র থেকে ছয়জন পরীক্ষার্থী এই কেন্দ্রে চলে আসে। বিষয়টি জানার পর পেশাগত দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবে তথ্য জানতে সেখানে যান দৈনিক সংবাদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি মেহেদী হাসান ও দৈনিক দেশ রূপান্তরের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি ফাতেমা আলী।
ভুক্তভোগী সাংবাদিকদের ভাষ্য অনুযায়ী, তারা দায়িত্বে থাকা অধ্যাপক ড. মো. আবদুল আলীমের কাছে পরীক্ষার্থীদের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি প্রথমে তাদের প্রশ্ন করার কারণ জানতে চান। সাংবাদিকরা বিষয়টি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করলেও তিনি হঠাৎ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। একপর্যায়ে তিনি সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, ‘স্টুপিড কোথাকার। আমাকে শিখাইতে আসছে কিভাবে কি করতে হবে। যাও এখান থেকে।’ অভিযোগ রয়েছে, এ সময় তিনি সাংবাদিকদের হেনস্তাও করেন।
দৈনিক দেশ রূপান্তরের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি ফাতেমা আলী বলেন, ‘আমরা খুব স্বাভাবিকভাবে তথ্য জানতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের ব্যাচ, ইয়ার নিয়ে কটূক্তি করা হয়। একজন শিক্ষক, তাও আবার ডিনের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি যদি সাংবাদিকদের সঙ্গে এভাবে কথা বলেন, তাহলে সেটি শুধু ব্যক্তিগত আচরণ নয়, এটি ক্ষমতার অপব্যবহার।’
এ ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে নতুন করে আলোচনায় এসেছে অধ্যাপক ড. মো. আবদুল আলীমের রাজনৈতিক অবস্থান ও প্রশাসনিক প্রভাব। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক সূত্র জানায়, তিনি সাবেক আওয়ামীপন্থী বিতর্কিত উপাচার্য অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমানের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। উপাচার্য মিজানুর রহমানের সময়কালে আলীম নানা সুবিধাও নিয়েছেন। আওয়ামীলীগের আমলে শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে তিনি প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
শুধু তাই নয়, সে সময় নীল দলপন্থী শিক্ষক নেতাদের সঙ্গেও তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। যা এখনও বজায় রয়েছে। নীল দলের একাধিক প্রভাবশালী নেতার সঙ্গে তার নিয়মিত যোগাযোগ ও বোঝাপড়ার কথা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ মহলে ‘ওপেন সিক্রেট’ হিসেবেই পরিচিত। নীলদলের নেতাদের সাথে নিয়মিতই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যেতেন তিনি। করতেন বিভিন্ন সুবিধা ভাগাভাগিও। তখন আওয়ামীপন্থী বলয়ে অবস্থান করেই তিনি প্রশাসনিক প্রভাব বিস্তার করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
পরিবর্তিত রাজনৈতিক বাস্তবতায় অধ্যাপক আলীমের অবস্থানও বদলেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বর্তমানে তিনি বিএনপিপন্থী সাদা দলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত এবং সেখানেও তার শক্ত প্রভাব রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক ও কর্মকর্তা বলছেন, দল বদলালেও ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে তিনি কখনোই দূরে থাকেননি। বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে নতুনভাবে ‘রিপ্যাকেজ’ করে এখন সাদা দলের ভেতর ‘গডফাদার’ হিসেবেই ভূমিকা রাখছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জ্যেষ্ঠ শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আলীম স্যার সব সময় ক্ষমতার সঙ্গেই থাকেন। আগে আওয়ামী ঘনিষ্ঠ ছিলেন, নীল দলের নেতাদের সঙ্গে উঠাবসা ছিল। এখন সাদা দলে প্রভাবশালী। এই রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ার কারণেই তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গেও এমন আচরণ করতে সাহস পান।’
ঘটনার পর প্রশাসনের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। উপাচার্যের কক্ষে গিয়ে সাংবাদিকরা বিষয়টি জানাতে চাইলে সেখানে উপস্থিত জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তরের পরিচালক ড. আনওয়ারুস সালাম বলেন, ‘একজন শিক্ষক এভাবে একজন শিক্ষার্থীকে বলতেই পারেন। এটা স্বাভাবিক বিষয়।’ তার এই মন্তব্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অবস্থানকে আরও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
অভিযোগের বিষয়ে অধ্যাপক ড. মো. আবদুল আলীম বলেন, ‘আমি তাকে স্টুপিড বলিনি। সেখানে অনেকে ছিল। আমি ডিনের দায়িত্বে আছি, আর সে আমাকে জ্ঞান দিতে আসছিল। এই কারণে কথা হয়েছে।’ তবে প্রত্যক্ষদর্শী ভুক্তভোগী সাংবাদিকদের বক্তব্য তার দাবির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. রেজাউল করিম বলেন, ‘আমরা বিষয়টি দেখছি। এখন ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত আছি। পরে বিষয়টি বিবেচনায় নেব।’ তবে সাংবাদিক ও শিক্ষক মহলের মতে, এ ধরনের বক্তব্য দায় এড়ানোরই নামান্তর।