
রাজধানীর বাড্ডায় গভীর রাতে নিজ বাসা থেকে দৈনিক ভোরের কাগজের অনলাইন বিভাগের প্রধান মিজানুর রহমান সোহেলকে তুলে নিয়ে যায় গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ১০ ঘন্টা পর ডিবি হেফাজত থেকে ফিরে তিনি বলেন, সরকারের একজন উপদেষ্টার ইশারায় মাত্র নয়জন মোবাইল ফোন ব্যবসায়ীকে মনোপলি ব্যবসার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য আমাকে আটক করা হয়েছে।
মঙ্গলবার (১৯ নভেম্বর) ঠিক রাত ১২টার কিছু পর পাঁচজন ব্যক্তি ডিবির জ্যাকেট পরে বাসায় গিয়ে তাকে নিয়ে যায়।
সোহেলের স্ত্রী সুমাইয়া সীমা জানান, দরজায় কড়া নাড়ার পর সোহেল গিয়ে দেখেন পাঁচজন ডিবি পরিচয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তাদের একজন নিজেকে আশরাফুল বলে পরিচয় দিয়ে জানান, “ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান সোহেলের সঙ্গে কথা বলতে চান। এজন্য তাকে নিতে এসেছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার তাকে ফিরিয়ে দিয়ে যাওয়া হবে।”
সীমা বলেন, তিনি তখন শুয়ে ছিলেন, আর সোহেল ল্যাপটপে কাজ করছিলেন। পরিস্থিতি বুঝতে পাশের রুম থেকে বেরিয়ে এলে তিনি পাঁচজনের পরিচয় ও উদ্দেশ্য জানতে চান। কর্মকর্তারা সোহেলকে নিয়ে যাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করেন। সীমার ভাষায়, “আমি খুবই চিন্তায় পড়েছি। রাত বাজে আড়াইটা এখনো ওরা দিয়ে যায়নি। আমি অসুস্থ, আমার বাচ্চাও অসুস্থ।”
এ বিষয়ে ডিবি প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার শফিকুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, সোহেলকে ডিবি কার্যালয়ে আনা হয়েছে। তিনি জানান, “সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে মিজানুর রহমান সোহেলকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডিবি কার্যালয় আনা হয়েছে।”
দীর্ঘ দুই দশকের বেশি সময় ধরে সাংবাদিকতা করে আসছেন মিজানুর রহমান সোহেল। ২০২৩ সালে তিনি দৈনিক ভোরের কাগজের অনলাইন বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন। এর আগে সাত বছর দৈনিক যুগান্তরের অনলাইন সম্পাদকীয় বিভাগে একই দায়িত্ব পালন করেন।
দেশের শীর্ষ অনলাইন সংবাদমাধ্যম ও ডিজিটাল নিউজরুম প্রধানদের সংগঠন ‘অনলাইন এডিটরস অ্যালায়েন্স’-এর সাধারণ সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
ডিবি অফিসে তুলে নেওয়ার ১০ ঘন্টা পর তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। ছাড়া পাওয়ারে পর মিজানুর রহমান জানান, "রাত ১২টার দিকে ডিবিপ্রধান আমার সঙ্গে কথা বলবেন, এই অজুহাতে ৫/৬ জন ডিবি সদস্য জোর করে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায়। ডিবিতে নিয়ে আসামির খাতায় আমার নাম লেখা হয়। জুতা-বেল্ট খুলে রেখে গারদে আসামিদের সঙ্গে আমাকে রাখা হয়। কিন্তু কেন আমাকে আটক করা হলো? তা আমি যেমন জানতাম না, তেমনি যারা আমাকে তুলে এনেছিলেন বা ডিবির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও কিছু বলতে পারেননি।"
তিনি আরও বলেন, "দীর্ঘ সময় পর বুঝতে পারলাম, সরকারের একজন উপদেষ্টার ইশারায় মাত্র নয়জন মোবাইল ফোন ব্যবসায়ীকে মনোপলি ব্যবসা করার সুযোগ দেওয়ার জন্যই আমাকে আটক করা হয়েছিল। আমার সঙ্গে সংগঠনের সেক্রেটারি আবু সাঈদ পিয়াসকেও আটক করা হয়। তিনি এখনও ডিবি কার্যালয়ে আছেন।"
তিনি ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের বিষয়ে উল্লেখ করে বলেন, "একটা ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কথা বললে সরকার কেন ভয় পায়? শুধুমাত্র প্রেস কনফারেন্স বন্ধ করতেই কি আমাকে গভীর রাতে জোর করে তুলে নিতে হলো? যারা মুখে ‘বাকস্বাধীনতা’র বুলি আওড়ান, তারাই কি আমাকে বাকরুদ্ধ করতে এই আয়োজন করলেন? মগের মুল্লুকে এই কি তবে বাকস্বাধীনতার বাস্তব চিত্র?"
বিনা পরোয়ানায় এবং মধ্যরাতে একজন সাংবাদিককে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছে অনলাইন এডিটরস অ্যালায়েন্স ও পাবনা জার্নালিস্ট ফোরাম। সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘ডিবিপ্রধান যদি কথা বলতেই চাইতেন, তবে তাকে দিনের বেলা ডাকা যেত অথবা নোটিশ দেওয়া যেত। তিনি নিজেই হাজির হতেন। রাত ১২টার পর বাসা থেকে তুলে নেওয়া মানে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করা, যা বর্তমান বাংলাদেশে কাম্য নয়।
আওয়ামী সরকারের পতনের পর আবারও ডিবি পরিচয়ে বিনা পরোয়ানায় বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনায় নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে।