দেশের পোশাক শিল্প নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। গত ১৪ মাসে সাভার, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদীতে মোট ৩৫৩টি গার্মেন্টস কারখানা বন্ধ হয়েছে, যার কারণে এক লাখ ১৯ হাজার ৮৪২ জন শ্রমিকের কর্মসংস্থান শেষ হয়ে গেছে। তথ্যটি নিশ্চিত করেছে গার্মেন্টস মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ।
সংগঠনটি জানিয়েছে, সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়েছে সাভারে। এখানে ২১৪টি কারখানা বন্ধ হয়েছে, যার মধ্যে ১২২টি স্থায়ী এবং ৯২টি অস্থায়ী। প্রায় ৩১ হাজার শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন। বন্ধ হওয়া কারখানার মধ্যে রয়েছে ছেইন অ্যাপারেলস, জেনারেশন নেক্সট ফ্যাশন ও সাফওয়ান আউটারওয়্যারের মতো বড় প্রতিষ্ঠান।
গাজীপুরেও অবস্থার অবনতি ঘটেছে। ৭২টি কারখানা বন্ধ হয়ে ৭৩ হাজারেরও বেশি শ্রমিক বেকার হয়েছেন। বিশেষ করে বেক্সিমকো গ্রুপের ১৩টি কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধ হওয়ায় এই অঞ্চলে ধাক্কা আরও বেশি।
অন্যদিকে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, নতুন অর্থবছরের শুরুতে জুলাই মাসে দেশের মোট রপ্তানি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৫ শতাংশ বেড়েছিল। কিন্তু এরপর তিন মাস ধরে নেতিবাচক ধারা দেখা দিয়েছে। অক্টোবরের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, রপ্তানি ৫১ কোটি ডলার কমেছে, যা স্থানীয় মুদ্রায় প্রায় ছয় হাজার ১২০ কোটি টাকা। গত বছরের অক্টোবরের তুলনায় রপ্তানি ৪১৩ কোটি ডলার থেকে এই বছর ৩৬২ কোটি ডলারে নেমেছে। তবুও অর্থবছরের প্রথম চার মাসের হিসাব অনুযায়ী রপ্তানিতে ২ শতাংশ বৃদ্ধি দেখা গেছে।
সম্প্রতি সরকার বাংলাদেশ শ্রম আইন (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে। তবে বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান বাবু বলেন, “আমরা আসলে এক ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। একেবারে যে খুব খারাপ অবস্থায় চলে গেছি, বিষয়টি এমন না। তবে এই ১৪ মাসে আরো ভালো করার সুযোগ ছিল। বিশেষ করে চীন ও ভারতের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের ফলে আমরা বেশ কিছু সুবিধা পেতে পারতাম। কিন্তু সেই সুযোগ আমরা হাতছাড়া করেছি।”
বিজিএমইএর সাবেক সহসভাপতি এ বি এম শামসুদ্দিন বলেন, “যদি সত্যি কথা বলি, তাহলে বাংলাদেশের গার্মেন্টস মালিকরা ভালো নেই। নির্বাচিত সরকারের দিকে চেয়ে বসে আছে বায়াররা। ছোট ফ্যাক্টরিগুলো টিকতে পারছে না। তারা বন্ধ করে চলে যাচ্ছে। এর মধ্যে সরকার শ্রম আইন সংশোধন করে আরেক বিপদ তৈরি করেছে। আসলে এখানে আমাদের কোনো অভিভাবক নেই। এতিমের মতো টিকে আছে সেক্টরটি।”
শ্রমিকদের পক্ষ থেকেও উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার সলিডারিটির প্রতিষ্ঠাতা কল্পনা আখতার বলেন, “জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে তো শ্রমিকরাও অংশ নিয়েছিলেন। বৈষম্য নিরসনের যে দাবিতে আন্দোলন হয়েছিল, সেটা নিরসন হয়নি। উল্টো কাজ হারিয়ে শ্রমিকরা বেকার হয়ে যাচ্ছেন। শ্রমিকদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। শ্রমিকেরা যে কাতারে ছিলেন সেই কাতারেই রয়ে গেছেন। যারা বেকার হয়েছেন তাদের সংসার কোনোভাবেই চলছে না। নতুন কিছু গার্মেন্টস হলেও সেখানে তো সবার কর্মসংস্থান হচ্ছে না।”
পোশাক খাত দেশের রপ্তানি আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস। বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক মনে করেন, এই সংকট শুধু শিল্প মালিকদের নয়, পুরো অর্থনীতির ওপর প্রভাব ফেলছে। তিনি বলেন, “আমেরিকার বাজারে মন্দা, চাহিদা কম এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার ফলে রপ্তানি কমছে। অনিশ্চয়তার মধ্যে বড় ক্রেতারা কার্যাদেশ দেবে না। এখন নির্বাচিত সরকার এলে হয়তো পরিস্থিতি বদলাতে পারে।”
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানিত ফেলো ড. গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, মালিকরা যতটা খারাপ বলছেন পরিস্থিতি ততটা খারাপ নয়। “গার্মেন্টস মালিকরা যা বলছেন তার সঙ্গে কিন্তু রপ্তানি সূচক মিলছে না। মালিকরা বলছেন, গার্মেন্টস বন্ধ হচ্ছে, অর্ডার নেই, শ্রমিকরা কাজ হারাচ্ছেন। কিন্তু আমাদের রপ্তানি সূচক দুই অংকের ঘরেই রয়েছে। শুধুমাত্র গত মাসে এক অংকে নেমেছে। অর্থাৎ আমাদের রপ্তানি আগের মতোই রয়েছে। হতে পারে বড় কারখানাগুলো থেকে রপ্তানি বেশি হচ্ছে, ছোট কারখানাগুলো হয়ত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আসলে নির্বাচিত সরকার ছাড়া সঠিক বিনিয়োগ হয় না।”
শ্রম আইন (সংশোধন) অধ্যাদেশ নিয়ে বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, “একতরফাভাবে সংশোধিত শ্রম আইন শিল্পে অস্থিরতা বাড়াবে। একই সঙ্গে বৈদেশিক বিনিয়োগ কমাবে, রপ্তানি খাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে ও দেশের অর্থনীতি দুর্বল করে তুলবে। নতুন আইনে শিল্প মালিক ও শ্রমিক কোনো পক্ষের স্বার্থই সংরক্ষিত হয়নি।” তিনি এটিকে ‘ভারসাম্যহীন’ ও ‘অযৌক্তিক’ আখ্যা দিয়ে বলেন, “উপদেষ্টা পরিষদে একতরফাভাবে শ্রম আইন সংশোধন করে মাত্র ২০ জন শ্রমিকের সম্মতিতে ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের বিধান করা হয়। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবতা বিবর্জিত। কারণ মাত্র ২০ জন শ্রমিক দিয়ে একটি ইউনিয়ন গঠন করা হলে কারখানাগুলোতে এমন ব্যক্তিরা ট্রেড ইউনিয়ন করবেন, যারা শিল্পসংশ্লিষ্ট নন। এটি অন্তর্দ্বন্দ্ব ও শিল্পে অস্থিতিশীলতা তৈরি করবে। এতে বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমবে এবং উদ্যোক্তারা নতুন প্রতিষ্ঠান স্থাপন বা পরিচালনায় নিরুৎসাহিত হবেন।”
বিজিএমইএ প্রধান সরকারের প্রতি আহবান জানান, শ্রম, শিল্প ও অর্থনীতির বাস্তব চাহিদা বিবেচনায় নতুন আইন প্রণয়ন করতে হবে। নতুন আইন যেন শিল্পের প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা নষ্ট না করে, বরং টেকসই উন্নয়নকে সমর্থন করে।
শ্রমিক সংগঠন থেকেও ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সহসভাপতি জলি তালুকদার বলেন, “বর্তমান সরকারের আমলে দুই থেকে তিন লাখ শ্রমিক কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েছেন। এই সরকারের সময়েও চারজন শ্রমিককে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এখন তারা ট্রেড ইউনিয়নও বন্ধ করতে চায়, যা কোনভাবেই প্রত্যাশিত না। বরং এই সরকারের সময় আমরা দেখেছি, বেতন-ভাতার আন্দোলনে যাওয়া শ্রমিককে গুলি করা হয়েছে। কোনো সুযোগ-সুবিধা তো বাড়েইনি, দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে শ্রমিকদের অবস্থা।”