
কারাগার সাধারণত অপরাধীদের সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন রেখে সংশোধনের জায়গা হলেও, ঝিনাইদহ জেলা কারাগারে ঘটছে উল্টো চিত্র। নিরাপত্তার চাদরে মোড়ানো এই স্থান থেকেই বন্দিরা স্মার্টফোন ব্যবহার করে মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ ও ফেসবুকে সক্রিয় রয়েছেন— এমনকি পরিকল্পনা করছেন চাঁদাবাজি, হুমকি ও প্রতারণার মতো অপরাধও।
সম্প্রতি এক অভিযান চালিয়ে কারা কর্তৃপক্ষ সেখানে থাকা কয়েকজন বন্দির কাছ থেকে অ্যান্ড্রয়েড ফোন, সিম কার্ড ও ইন্টারনেট ব্যবহারের নানা যন্ত্রাংশ জব্দ করে। উদ্ধার হওয়া ডিভাইস ঘেঁটে দেখা যায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বার্তা আদান-প্রদান থেকে শুরু করে ভয়েস এবং ভিডিও কলে চলছিল অপরাধ চক্রের নির্দেশনা, লেনদেন ও যোগাযোগ।
এই ঘটনায় দায়িত্বরত কয়েকজন কারাকর্মীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে প্রশাসন।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, ঝিনাইদহ জেলা কারাগারে বসে বন্দিরা নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন বাইরে থাকা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে। তাদের কেউ কেউ আবার ভয়ভীতি প্রদর্শন ও চাঁদা আদায়ের মতো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে সরাসরি জড়িত। এমনকি সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের ঠিকাদারি কার্যক্রমেও হস্তক্ষেপ করছেন তারা।
সূত্র আরও জানিয়েছে, কারাগারের ভেতরে ঘুষের বিনিময়ে নির্বিঘ্নে পৌঁছে যাচ্ছে মাদকসহ নানা নিষিদ্ধ সামগ্রী। বন্দিরা টাকার বিনিময়ে পাচ্ছেন মোবাইল, ইন্টারনেট সুবিধা—সব কিছুই যেন হাতের মুঠোয়।
বিশেষভাবে আলোচনায় এসেছে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টুর নাম। তিনি কারাগারে থেকেও মোবাইল ব্যবহার করে যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছিলেন বলে অভিযোগ ওঠে। বিষয়টি প্রকাশ্যে এলে তাকে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। এছাড়াও আরও কয়েকজন প্রভাবশালী বন্দি মেসেঞ্জার ও হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করছেন বলে গোপন সূত্রে জানা গেছে।
একাধিক সূত্র বলছে, কারাগারে পর্যাপ্ত প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারি না থাকায় মোবাইল চোরাচালান থামানো যাচ্ছে না। অনেক সময় দুর্নীতিপরায়ণ কারারক্ষীদের সহায়তায়ই এসব ডিভাইস পৌঁছে যাচ্ছে বন্দিদের হাতে।
এ বিষয়ে মানবাধিকারকর্মী আমিনুর রহমান টুকু বলেন, “কারাগারে বন্দিদের হাতে অ্যানড্রয়েড মোবাইল থাকা শুধুই নিয়ম লঙ্ঘন নয়, এটি পুরো আইন-শৃঙ্খলাব্যবস্থার জন্য হুমকি। এসব প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে কারাগার এখন অপরাধ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “কারাগারে প্রযুক্তি ব্যবহারের ওপর কারা কর্তৃপক্ষের যথাযথ নজরদারি প্রয়োজন। তা না হলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটবে।”
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মো. জাকারিয়া বলেন, “বিধি অনুযায়ী একজন বন্দি কারা কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী তার পরিবারের সঙ্গে মোবাইলে কথা বলতে পারবে। তবে বন্দিদের অ্যানড্রয়েড মোবাইলের মাধ্যমে মেসেঞ্জার-হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করা আইনগত অপরাধ। কারা কর্তৃপক্ষের যোগসাজশ ছাড়া কোনো বন্দি এমন ঘটনা ঘটাতে পারে না।”
ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে ঝিনাইদহ জেলা কারাগারের ভারপ্রাপ্ত জেলার আবু ইউসুফ মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
এদিকে, ঝিনাইদহের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এ বি এম খালিদ হোসেন সিদ্দিকী বলেন, “বিষয়টি জানার পর জেলা কারাগারের দায়িত্বরত কয়েকজনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। একজনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “বিভিন্ন সূত্রের মাধ্যমে আমরা বন্দিদের হোয়াটসঅ্যাপ-মেসেঞ্জার ব্যবহার করার তথ্য সংগ্রহ করছি। কারাগারে দায়িত্বরত যারা এ ধরনের কর্মকাণ্ডে সহযোগিতা করছে, তাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করা হবে।”